মাদ্রাসার শিশুদের অধিকার কি আলাদা?
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০পরবর্তীতে এই শিশুদের এক অংশ চলে যায় স্কুলে, আরেক অংশের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার শুরু হয় মাদ্রাসাতে৷ নিজেদের নয়, অভিভাবকের আকঙ্খাতে বদলে যায় তাদের চাওয়া পাওয়া, সুযোগ সুবিধাগুলো৷ ঠিক যেমন বদলে গিয়েছিল সিয়ামের জীবনও৷
বন্দি জীবনে আটকে যায় তার উড়ন্ত শৈশব৷ যেই সময়টা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার, আনন্দে কাটানোর-- সেই সময়টায় কঠিন এক জীবন আবদ্ধ করে ফেলে তাকে৷ অন্য কোনো বিনোদন তো দূরে থাক, তার দৈনন্দিন রুটিন থেকে ‘খেলাধুলা’ শব্দটিই নাই হয়ে যায়৷ ‘‘খেলতে ইচ্ছা করতো, তবে কেউ বলার সাহস পেতো না,’’ বলছিলেন কওমি, আলিয়া মিলিয়ে এখন পর্যন্ত তিনটি মাদ্রাসায় পড়া এই দাখিল শিক্ষার্থী৷ হাফেজি পড়া অবস্থায় মাদ্রাসার ভিতরে তাদের খেলার মতো কোনো মাঠ ছিল না৷ চার দেয়ালের বাইরে বের হওয়াও ছিল নিষিদ্ধ৷ ছুটিতেই কেবল বাহিরের পৃথিবীটা দেখার সুযোগ মিলতো৷
সিয়ামের বাড়ি ফেরার পরের সময়ের বর্ণনা দিলেন তার বড় বোন রুবাইয়া৷ ‘‘যখন ওকে বাসায় আনা হতো, তখন সে ঠিকমতো কথা বলতো না৷ বাইরের কারো সঙ্গে মিশতে পারতো না৷ এখন ধীরে ধীরে কিছুটা ঠিক হয়েছে৷’’
রুবাইয়াও দুইটি কওমি মাদ্রাসায় পড়েছেন৷ সেই আট বছর বয়সে একটি ‘মহিলা হাফেজিয়া মাদ্রাসায়’ ভর্তি হয়েছেন৷ রুবাইয়ার কথা অনুযায়ী, মাদ্রাসার আয়তন ছোট ছিল, সারাদিন তাদের রুমের মধ্যেই থাকতে হতো৷ বিকেলের দিকে নীচে নামার সুযোগ ছিল, তবে সেটা ছিল বিল্ডিংয়ের গণ্ডির মধ্যেই৷ গেইটের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না৷ ‘‘বন্দিজীবন কাটিয়েছি ছোটবেলা থেকেই৷ মাঝে মাঝেই ইচ্ছা করতো খেলাধুলার, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর কিন্তু তার কোনো সুযোগ ছিল না৷’’ মেয়ে হওয়ায় এমনকি দৌড়াদৌড়ি, উচ্চ শব্দে হাসাহাসিতেও বারণ ছিল, বলছিলেন তিনি৷ পরবর্তীতে আরেকটি মাদ্রাসায় কিছুটা বৃহৎ গণ্ডি পেয়েছেন৷ তবে সেখানেও বিনোদন বলতে বড়জোর ভবনের ছাদে হাঁটাহাঁটির সুযোগ৷ বলেন, ‘‘ফজর থেকে রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত রুটিন মেনে চলতে হতো৷ মিনিট বা সেকেন্ড এদিক-সেদিক হতে পারবে না৷ কিন্তু সব সময় মানসিকাতো এক রকম থাকে না৷’’
তবে সিয়াম রুবাইয়া দুইজনই বললেন, কওমির তুলনায় আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে এতটা কড়াকড়ি নেই৷ সুযোগ স্বল্প হলেও খেলাধুলায় বাধা নেই৷
বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা মূলত দুই ধরনের৷ ‘‘যা প্রাথমিক পর্যায়ের পরে শিক্ষা দান করে; এগুলো হচ্ছে: আলিয়া মাদ্রাসা, যেগুলো কলকাতা মাদ্রাসাকে (পরবর্তী সময়ে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা) অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠিত সরকার-সমর্থিত প্রতিষ্ঠান এবং কওমি মাদ্রাসা, যেগুলো সাধারণত দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুকরণে তৈরি বেসরকারি ব্যবস্থাপনার মাদ্রাসা৷ তবে আলিয়া এবং কওমি দুই ধরনের মাদ্রাসাতেই প্রাথমিক পর্যায়, অর্থাৎ ইবতেদায়ি শিক্ষা দেওয়া হয়৷ দুই ব্যবস্থার বাইরেও কিছু ক্ষেত্রে স্বাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ইবতেদায়ি মাদ্রাসা রয়েছে৷’’ এই দুই ধরনের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ‘বাংলাদেশে মাদ্রাসাশিক্ষা: প্রতিযোগিতা, সমঝোতা ও আদর্শিক দ্বন্দ্ব’, শিরোনামে একটি প্রবন্ধে এভাবে বর্ণনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননীয় অধ্যাপক আলী রিয়াজ৷ (লেখাটি মূল ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে ছেপেছে প্রতিচিন্তা)
সরকারের মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে প্রায় সাড়ে নয় হাজার আলিয়া মাদ্রাসা রয়েছে৷ বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর হিসাবে প্রাথমিক র্পযায়ে স্বাধীন ইবতেদায়ি মাদ্রাসার সংখ্যাই ২০১৯ সালে ছিল ৬,৩৭৮ টি৷ যেখানে নয় লাখ ৬১ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে৷ এর ৫৩ ভাগই ছাত্রী৷
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের নীতিমালা অনুযায়ী, এই ধরনের মাদ্রাসা অনুমোদনে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য র্পযাপ্ত খেলার মাঠ থাকতে হবে৷ আবার দাখিল, আলিম, ফাযিল, কামিল মিলিয়ে এই বোর্ডের অধীনে মোট মাদ্রাসা সংখ্যা ৯২৭৮ টি৷ যার মধ্যে মাত্র তিনটি সরকারি, বাকিগুলো বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত৷ তবে কাগজে-কলমে সবাই সরকারি কারিকুলাম মেনেই চলে৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী এই মাদ্রাসাগুলোতে একজন করে শারীরিক শিক্ষক থাকার কথা, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন হওয়ার কথা৷ ‘‘শিক্ষার্থীরা যখন ভর্তি হয় বা ফরম পূরণ করে তখন ক্রীড়া ফির নামে একটা নির্দিষ্ট অর্থ নেওয়া হয়৷ এই অর্থ দিয়ে আমাদের অধিদফতরের নেতৃত্বে দুটো ক্রীড়া অনুষ্ঠান হয়৷ একটা শীতকালীন ও আরেকটা গ্রীষ্মকালীন৷ এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় প্রতিষ্ঠান থেকে উপজেলা, জেলা ও বিভাগ হয়ে কেন্দ্রীয় প্রতিযোগিতা হয়,’’ ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষা র্বোডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কায়সার আহমেদ৷ তবে মাদ্রাসাগুলোতে শারীরিক শিক্ষক, খেলাধুলার অবকাঠামো এবং এজন্য পর্যাপ্ত সরকারি বরাদ্দ না পাওয়ার অভিযোগ আছে৷
তবে কওমি মাদ্রাসাগুলোর উপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই৷ সেগুলো চলছে তাদের তৈরি স্বাধীন নিয়মে৷ এমন মাদ্রাসার সঠিক পরিসংখ্যানও নেই কারো কাছে৷ তাদের একাধিক বোর্ডের একটি ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’, যাদের অধীনেই ১৩,৭১০ টি মাদ্রাসা রয়েছে৷ সেগুলোতে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা, বিনোদন বা সৃজনশীলতা বিকাশের কতটুকু সুযোগ দেয়া হয় তা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷
এইসব মাদ্রাসায় শত বা হাজার নয় কয়েক লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে৷ সিয়াম আর রুবাইয়াদের মতো তাদের অনেকেই বড় হচ্ছে খেলাধুলাবিহীন নিরানন্দ এক পৃথিবীতে৷ ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই যেন ধরেই নিয়েছে মাদ্রাসায় পড়া শিশুদের এই পৃথিবীর আনন্দ উপভোগের প্রয়োজন নেই৷ কালেভদ্রে পাঞ্জাবি, টুপি পরা মাদ্রাসার ছাত্র কিংবা বোরকা পরা মেয়েদের খেলার দৃশ্য দেখলেও তাই আমরা বিষ্মিত হই৷
অথচ প্রতিটি শিশুর জন্য সমঅধিকার নিশ্চিত করা কিন্তু রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব৷ জাতিসংঘের শিশু অধিকার চুক্তি ১৯৮৯-র ৩১ ধারাতেও স্পষ্ট বলা হয়েছে, বয়সের সাথে সঙ্গতি রেখে শিশুর বিশ্রাম, অবসর, খেলাধুলা ও বিনোদনমূলক কার্যক্রম, সুকুমার শিল্পে অংশগ্রহণের অবাধ অধিকার অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ স্বীকার করবে৷ রাষ্ট্র শিল্প ও সাংস্কৃতিক জীবনে শিশুর পরিপূর্ণ অংশগ্রহণ এবং সাংস্কৃতিক, সুকুমার শিল্প ও বিনোদনের জন্য উপযুক্ত ও সমানভাবে অংশগ্রহণকে উত্সাহিত করবে ৷
এই সনদে স্বাক্ষরকারী বাংলাদেশ কি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য সেগুলো নিশ্চিতের কোনো তাগিদ বোধ করে? জাতি, লিঙ্গ, ধর্ম, ভাষা, সক্ষমতা অথবা অন্য কোনো সামাজিক মর্যাদা যাই হোক না কেন, প্রতিটি
শিশুরই এই অধিকারগুলো যে আছে বাংলাদেশের মানুষও কি আদৌ তার প্রয়োজন অনুধাবন করতে পারে?
গতবছর জুনের ছবিঘরটি দেখুন...