1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মারাদোনাকে ‘ঈশ্বর’ বলিয়া লজ্জা দেবেন না

২৭ নভেম্বর ২০২০

কিছু সাংবাদিক খুব কষ্টের সময়েও কষ্ট বাড়িয়েছিলেন৷ সেরকম কয়েকজনের ওপর গুলি চালিয়েছিলেন মারাদোনা৷ সমর্থকদের বাড়াবাড়িও মাত্রা ছাড়িয়েছে নানা সময়৷ ফুটবল মহাতারকাকে ওপারেও মনে হয় শান্তি দিচ্ছেন না তারা৷

https://p.dw.com/p/3lvNO
মারাদোনা
১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচ জেতার পর ট্রফি হাতে উল্লাসিত মারাদোনাছবি: Carlo Fumagalli/AP Photo/picture alliance

জীবন বড় অদ্ভুত৷ আপনাকে এই হাসাবে, এই কাঁদাবে৷ এই আনন্দে ভাসাবে, পরক্ষণেই সেই আনন্দ ভাসিয়ে দেবে দুঃখের সুনামি৷ মারাদোনার ষাট বছরের জীবনটা তো নিষ্ঠুর এই সত্যের হাত ধরেই কেটে গেল৷ নিদা ফজলির একটা গজল খুব মনে পড়ছে,

‘‘জীবন ক্যায়া হ্যায়

চলতাফিরতা এক খিলোনা হ্যায়,

দো আঁখোমে একসে হাসনা

একসে রোনা হ্যায়৷''

জীবন তো এক অর্থে সচল খেলনার মতোই৷ খেলনাটা দিব্যি চলে-ফেরে, হাসে-কাঁদে৷কারো কারো জীবনে হাসি-কান্না সমান সমান৷ তাদের এক চোখ যেন শুধু হাসে আর অন্য চোখ কাঁদে৷

দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনার জীবনে আনন্দ বেশি, নাকি বেদনা?

১৯৯৪-র ওই সময়টায় সামান্যতম আনন্দও ছিল না তার জীবনে৷ যুক্তরাষ্ট্রে আর্জেন্টিনাকে তৃতীয় বিশ্বকাপ জেতানোর আশা নিয়ে গিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে ড্রাগ টেস্টে পজিটিভ হয়ে৷ নিজে লজ্জায় ডুবেছেন, দেশকেও ডুবিয়েছেন৷ রক্তে এফিড্রিন পাওয়ায় বিশ্বকাপ থেকে তাকে বিদায় করা হয়েছে আর সেই ধাক্কা সামলাতে না পারায় আর্জেন্টিনার ট্রফি জয়ের স্বপ্নও মুখ থুবড়ে পড়েছে শেষ ষোলোতে৷

এমন পরিস্থিতিতে একটু শান্তি, একটু নিরুপদ্রব জীবন কে না চায়, বলুন? কিন্তু মারাদোনাকে সামান্য শান্তির আশায় হাতে নিতে হয়েছিল বন্দুক৷ সাংবাদিকদের বিরামহীন উৎপাতে অতিষ্ঠ মারাদোনা সরাসরি গুলি চালিয়েছিলেন বুয়েনস আইরেসের বাড়ির বারান্দা থেকে৷ চারজন আহতও হয়েছিলেন এয়ার রাইফেলের গুলিতে!

ভীষণ অন্যায় করেছিলেন৷ পরে তা স্বীকারও করেছেন৷ ফুটবলের মহাতারকা হলেও আবেগে ঠাসা রক্তমাংসের মানুষ তো, তাই হিতাহিত ভুলেছেন বারবার, ভুলও করেছেন অসংখ্য৷

মারাদোনাকে প্রথম দেখেছিলাম ৩৮ বছর আগে, ১৯৮২-র বিশ্বকাপে৷ সে আসরে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ম্যাচটার কথা এখনো বেশ মনে আছে৷ চার বছর আগে বয়স কম বলে তাকে বিশ্বকাপ দলে নেননি কোচ মেনোত্তি৷ মারাদোনাকে ছাড়াই ১৯৭৮ বিশ্বকাপ জেতে স্বাগতিক আর্জেন্টিনা৷ তবে স্পেনে পরের আসরে দানিয়েল পাসারেলা, দানিয়েল বার্তোনি, রামন দিয়াজদের দলে মারাদোনাও ছিলেন৷ তবু শিরোপা ধরে রাখার মিশনে বাজেভাবে ব্যর্থ হলো আর্জেন্টিনা৷ বেলজিয়ামের সঙ্গে প্রথম ম্যাচ হারার পর এল সালভাদর আর হাঙ্গেরিকে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে গেলেও সেখানে ইতালি আর ব্রাজিলের সঙ্গে হেরে বিদায় নিতে হয় আসর থেকে৷ আবেগ বেশি বলে ব্রাজিলের বিপক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেও মেজাজ হারিয়েছিলেন মারাদোনা৷ লাল কার্ড দেখে নিজে মাঠ ছেড়েছিলেন, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে ৩-১ গোলে হেরে আর্জেন্টিনাও বিদায় নিয়েছিল বিশ্বকাপ থেকে৷

মারাদোনার ফুটবল ক্যারিয়ারটা আমার কাছে তাই ১৯৮২-র ব্রাজিল ম্যাচ আর ১৯৯৪-র নাইজেরিয়া ম্যাচের ফ্রেমে বন্দি৷ তার প্রথম বিশ্বকাপ শেষ হয়েছে ভুল দিয়ে আর শেষ বিশ্বকাপ মহাভুল দিয়ে৷ মাঝে নিশ্চয়ই আলোকোজ্জ্বল অর্জনও আছে অনেক৷ সেরা অর্জন নিশ্চয়ই আর্জেন্টিনাকে প্রায় একা ১৯৮৬-র বিশ্বকাপ জেতানো৷ সেখানে তার পারফর্ম্যান্স কতটা অসাধারণ ছিল এ নিয়ে প্রচুর লেখা, কথা হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে৷ তবে অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতো এত সুন্দর করে সাদা-কালো টেলিভিশনের জমানায় মেক্সিকো থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে এশিয়ার দরিদ্র কোনো দেশে বসে মারাদোনাময় বিশ্বকাপ দেখার আনন্দের কথা মনে হয় আর কেউ লিখতে পারবেন না৷

আশীষ চক্রবর্ত্তী
আশীষ চক্রবর্ত্তী, ডয়চে ভেলেছবি: DW/T. Mehedi

‘আনন্দমেলা'র পূজাবার্ষিকীতে অন্নদাশঙ্কর লিখেছিলেন,

‘‘ধিনতা ধিনা পাকা নোনা
কাপ জিতেছে আর্জেন্টিনা,
দেখছি বসে টিভি খুলে
রাত্রি জেগে নিদ্রা ভুলে,
মেক্সিকোতে যাচ্ছে শোনা
মারাদোনা, মারাদোনা৷

 

তা ধিনতা ধিনা ধিনা
বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনা,
ফকল্যান্ডের যুদ্ধে হেরে
ইংল্যান্ডকে দিল মেরে,
শোধবোধ অস্ত্রবিনা
আর্জেন্টিনা আর্জেন্টিনা৷''

৩৮ বছরে মারাদোনাকে খুব বেশি হয়ত দেখিনি, তার সম্পর্কে খুব বেশি হয়ত জানিনি, তবে যতটুকু দেখেছি-জেনেছি, তাকে একেবারে সাধারণ একটি মানুষের মননে গড়া অসাধারণ এক ফুটবল শিল্পীই মনে হয়েছে আমার৷ নইলে একটা মানুষ খেলোয়াড়ি জীবনের এত অবিস্মরণীয় কীর্তির পাশাপাশি এত এত বিস্মরণযোগ্য, অননুকরণীয় দৃষ্টান্তও রেখে যেতে পারেন!

অনেকেই তাকে ‘ফুটবল ঈশ্বর' বলছেন, লিখছেন৷ কেন লিখছেন কে জানে! মারাদোনাকে কোনো হিসেবে কোনো জগতেরই ‘ঈশ্বর' মনে হয় না আমার৷ তাকে সেরকম ভাবতে রীতিমতো হাসি পায়, লজ্জা পায়৷ মনে হয়, তাকে ‘ঈশ্বর' বলা হচ্ছে জানলে মারাদোনাও নির্ঘাত লজ্জা পাবেন৷

জীবনে অনেক ভুল করেছেন৷ মাদক সেবন করেছেন, মদে আসক্ত হয়ে জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়েছেন৷ ইটালিতে নিজের সন্তানকে অস্বীকার করতে প্রথম স্ত্রী ক্লাউডিয়ার কাছে মিথ্যে বলেছেন ১৮ বছরের সংসার ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত, ড্রাগ টেস্টে পজিটিভ হয়ে সন্তানের মাথায় হাত রেখে দিব্যি দিয়ে প্রথমে নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও পরে ঠিক অপরাধ স্বীকার করেছেন- এসব তো ঈশ্বরের গড়া পৃথিবীর সাধারণ বাসিন্দাদেরই মানায়৷

তাছাড়া মারাদোনা চিরস্মরণীয় থাকবেন ভুবন ভোলানো ক্যারিশমা এবং নৈপুণ্যের কারণে, সর্বোচ্চ সাফল্যের জন্য কিন্তু নয়৷ তার চেয়ে বেশি গোল বা তার চেয়ে বেশি ট্রফি তো অনেকের ঝুলিতেই আছে৷ মোদ্দা কথা, ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যান বা টেন্ডুলকার, এমনকি টেনিসে পিট সাম্প্রাস বা রজার ফেদারারও যেমন নিজের সময়ে সব বিবেচনাতেই সেরার উচ্চতায় থেকেছেন, ফুটবলে মারাদোনা তা পারেননি৷

মারাদোনার অন্য কারো মতো হওয়ার দরকারও নেই৷ তিনি বরং বস্তি থেকে উঠে এসে দু'পায়ের কারুকাজে সারা বিশ্বকে মোহাচ্ছন্ন করা খেটে খাওয়া শ্রেণির প্রতিনিধি, কিংবা নায়ক হিসেবেই বেঁচে থাকুন আমাদের হৃদয়ে৷ সে নায়ক প্রতিবাদী৷ সে নায়ক পায়ে কাস্ত্রো, হাতে চে গেভারার উল্কি আর বুকে শোসনের অবসানের স্বপ্ন আঁকেন৷ সেই নায়ক ফকল্যান্ড যুদ্ধের বদলা নেন ফুটবল মাঠে, ‘ঈশ্বরের হাত' দিয়ে৷ এবং সেই নায়ক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে মনে করতেন কার্টুন!

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য