মার্কিন চাপের মুখে বাংলাদেশের পাশে চীন-রাশিয়া?
১৫ জুন ২০২৩তবে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, বাংলাদেশ কোনো একটি দিকে না ঝুঁকে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইছে। বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপনের যে লড়াই চলছে তাতে কোনো দিকে এককভাবে অবস্থান নিতে চাইছে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে নিয়ে টানাটানি চলছে। আর বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নীতি নিয়ে যে কাজ করছে তারই অংশ হিসেবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মার্কিন ‘চাপের' মুখে আছে বাংলাদেশ। চীন এর বিপরীতে যে কথা বলছে, তা আসলে দুই দেশের অবস্থানকে বিবেচনায় নিয়ে বলছে।
এদিকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্যের বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইইউতে চিঠি পাঠানোর পরই মার্কিন কংগ্রেসের ছয় সদস্য সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে চিঠি দিয়েছেন। তারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা আশা করছেন। তারা বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ছয় কংগ্রেসম্যান তাদের চিঠিতে বলেছেন, " মার্কিন কর্মকর্তাদের সুস্পষ্ট ও বারবার বিবৃতি ও পদক্ষেপ বাংলাদেশ সরকার তার মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা মেনে চলা নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে পারে। আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, ইতিমধ্যে বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে গণগ্রেপ্তার এবং সহিংসতা হয়েছে, যা নির্বাচনের ফলাফলকে কলঙ্কিত করতে পারে এবং সামাজিক সংঘাতকে আরো গভীর করতে পারে।”
এদিকে বাংলাদেশের বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী র্যাব ও এর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে চীন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষায় চীন সব সময় সমর্থন দেবে বলেও জানিয়েছে। বুধবার বেইজিংয়ে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন এ কথা জানান।
আর বাংলাদেশের পরররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জেনেভায় বুধবার জানিয়েছেন বাংলাদেশ আগস্টে ব্রিকস-এর সদস্য হতে পারে। চীন, রশিয়া, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার একটি অর্থনৈতিক জোট এটি। আগস্টের শেষে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস-এর পরবর্তী শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা। এর সদর দপ্তর চীনের সাংহাইয়ে।
র্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি প্রণয়ন করেছে। সেই নীতি অনুযায়ী যারা বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করবে, তাদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেয়া হবে না।
বাংলাদেশ কোন দিকে
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, " যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে তা তো স্পষ্ট। তবে এই চাপ যে শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে তা আমার মনে হয় না। এর পিছনে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের বিষয় আছে। যুক্তরাষ্ট্র এখান থেকে চীনকে বিদায় করতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ তাতে সমর্থন দেবে কেন?”
তার কথা,‘‘বিশ্বব্যাপী একটি সংকট চলছে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। সেখানে বাংলাদেশকে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। তাকে ব্যালেন্স করতে হচ্ছে। আমরা মনে হয় এখন পর্যন্ত সেটা সঠিকভাবেই করা হচ্ছে৷’’
‘‘কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অনেক সমস্যা আছে। এই সমস্যা আমাদেরই মেটাতে হবে। আমাদের সমস্যা আর কেউ মিটাবে বা অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে, সেটা হতে দেয়া উচিত নয়,’’ বলে মনে করেন মুন্সি ফয়েজ আহমেদ৷
তার কথা, ‘‘মার্কিন কংগ্রেসম্যানরা চিঠি দিচ্ছেন। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা চিঠি দিচ্ছেন। তারা সংখ্যায় কম। কিন্তু এটা বাইডেন প্রশাসন বা ইইউ কীভাবে নেয়, সেটা দেখার বিষয়। এগুলোসহ মার্কিন ভিসা নীতি, র্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা এসব বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্কভাবে কাজ করতে হবে। আর কোনো দেশ যদি আমাদের সমর্থন করে, তাহলে তো আমরা তাদের বলতে পারি না যে, তোমরা আমাদের সমর্থন কোরো না’’
তিনি মনে করেন, ‘‘ব্রিকস-এ বাংলাদেশে যোগ দিলে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের নারাজ হওয়ার কিছু নেই। চীন ও রাশিয়া যেমন এর সদস্য, তেমনি ভারতও সদস্য। আর এটা কোনো সামরিক জোট নয়, এটা অর্থনৈতিক জোট।’’
তবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন, ‘‘ব্রিকস-এর আগামী শীর্ষ সম্মেলনে ডলারের ‘কাউন্টার' হিসেবে একটি শক্তিশালী মুদ্রা দাঁড় করানোর এজেন্ডা আছে। সেটা কতটা সফল হবে জানি না, তবে এটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কনসার্ন আছে। কারণ, তারা ডলারের অধিপত্য ধরে রাখতে চায়।’’
তার কথা, ‘‘এখন বাংলাদেশকে নিয়ে যা হচ্ছে তাতে বাংলাদেশ টানাটানির মধ্যে পড়ে গেছে। চীন যা বলছে সেটা তার দেশের অবস্থান থেকে বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতার অবস্থান থেকে বলছে। এইসব বিষয়ে আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। আমরা যদি দুই পরাশক্তির ঘুর্ণির মধ্যে পড়ে যাই, তা সামলানোর মতো সক্ষমতা আমাদের আছে বলে মনে করি না।’’
তিনি মনে করেন, ‘‘বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিচেছ। তারা এখানকার গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুকে সামনে এনেছে। তাদের আধিপত্যের বিষয় আছে। কিন্তু আমাদের যে সমস্যা আছে, তা যদি আমরা নিজেরাই মিটিয়ে ফেলতে পারি, তাহলে তো যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বলার থাকবে না। আমাদের সেটাই করা উচিত।’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বাইরে থেকে যা দেখছি, তাতে আমাদের কূটনীতিতে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান আছে। এই ভারসাম্য থেকে কোনোভাবেই সরা যাবে না। সেটা অর্থনীতিসহ নানা কারণে। বিশ্ব রজনীতির যে টানাপোড়েন চলছে, সেখানে আমাদের কোনো পক্ষে যাওয়ার সুযোগ এবং সক্ষমতা নেই।’’