মার্কিন নির্বাচন: ইউনূস সরকারের কূটনৈতিক সমীকরণ
৩ নভেম্বর ২০২৪বাংলাদেশ একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আসা অন্তর্বর্তী সরকার নানা ধরনের সংস্কার কার্যক্রমের উদ্যোগ নিয়েছে৷ আছে নির্বাচনের তাগিদ৷ ড. ইউনূসের সরকারকে শুরু থেকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন৷ ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস নির্বাচনে জিতলে সেই সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকেরা৷ কিন্তু রিপাবলিকান প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্প জিতলে কী হবে? এই সমর্থন কি চলে যাবে? কূটনীতিকেরা অবশ্য তেমনটা মনে করেন না৷ তবে ট্রাম্পের ওপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একটা বড় প্রভাব আছে বলে তারা মনে করেন৷ তাতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এখন যে সম্পর্ক তাতে ট্রাম্প জিতলে নরেন্দ্র মোদী তাকে প্রভাবিত করতে চাইবেন৷ বিশ্লেষকদের মতে তার ফল এমন হবে না যে ট্রাম্প হাসিনা সরকারকে আবার বসাতে চাইবে৷
মার্কিন নির্বাচন: ট্রাম্প-হ্যারিসের নীতি
সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলি বলেন, ‘‘কমলা হ্যারিস মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলে কী হবে তা বলা সহজ৷ কারণ তিনি জো বাইডেনের নীতির ধারাবাহিকতাই রক্ষা করবেন৷ তিনি ডেমোক্র্যাটদের নীতিই অনুসরণ করবেন৷ কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে ইইক্রেন যুদ্ধ যেকোনভাবে শেষ করবেন৷ তবে ইসরায়েল নীতি আরো কড়া হলে মধ্যপ্রাচ্যে সংকট আরো বাড়তে পারে৷''
ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারের অন্যতম ইস্যু অভিবাসন৷ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির মনে করেন তিনি জিতলে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তন আসবে৷ এতে বাংলাদেশের অভিবাসী, সেখানে যেসব বাংলাদেশি ছাত্ররা পড়তে যান তাদের জন্য সমস্যা হতে পারে৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের যারা ওখানে আছেন তারাও ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন৷ আর ট্রাম্প জিতলে রোহিঙ্গাদের জন্য আগের মতো তহবিল পাওয়া যাবে কি না তাও নিশ্চিত নয়৷'' তবে ব্যবসা বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নেই বলেই মনে করেন তিনি৷
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল(অব.) মো. শহীদুল হক বলেন ট্রাম্পের নীতি কেমন সেটি তার আগের মেয়াদ থেকে ধারণা পেয়েছে বিশ্ববাসী৷ বলেন, ‘‘পুতিনের মিত্র ট্রাম্প এবার বিশ্বকে কোন দিকে নেবেন সেটাই দেখার বিষয়৷ তিনি চান যুক্তরাষ্ট্রকে আরো ধনী করতে৷ তার আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে৷''
ট্রাম্পের বক্তব্য ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
ট্রাম্প সম্প্রতি তার এক্স বার্তায় লিখেছেন, ‘‘আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি৷ দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে৷ বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিভাবে একটি নৈরাজ্যকর অবস্থার মধ্যে রয়েছে৷’’
ট্রাম্পের এই বক্তব্য কি বাংলাদেশ সম্পর্কে তার বিদেশ নীতির প্রতিফল? ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা হুমায়ূন কবির বলেন, ‘‘এটা আসলে নীতির চেয়ে বড় হলো নির্বাচনে ভোটের ব্যাপার৷ মার্কিন নির্বাচনে ভারতীয় অভিবাসী এবং অভিবাসী হিন্দুদের একটা ভূমিকা আছে৷ ট্রাম্প তার কথা দিয়ে হয়তো তাদের ভোট টানতে চাইছেন৷ তার গত টার্মেও তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে কথা বলেছেন৷ তখন তো আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিলো৷''
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন সরকার পরিবর্তন হলেও মার্কিন বিদেশ নীতিতে সাধারণত বড় ধরনের পরিবর্তন হয় না৷ তবে ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকানদের রাজনীতিতে পার্থক্য আছে৷ আছে নিজস্ব চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিও৷ সেই বিবেচনায় কমলা হ্যারিস ও ট্রাম্পের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে৷ বাংলাদেশকে তা বিবেচনায় রাখতে হবে৷
কূটনীতিক সাকিব আলি বলেন, ‘‘আবারো ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় আসলে, কমলা হ্যারিস মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলে বাংলাদেশে বর্তমানে যে সরকার আছে তাদের জন্য সুবিধা হবে৷ তাদের তাদের সংস্কার কাজ, নির্বাচন এগুলো করা সহজ হবে৷ কারণ আগে থেকেই জো বাইডেন সমর্থন দিয়ে রেখেছেন৷’’
এক্ষেত্রে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে ইউনূস সরকারের সাথে মার্কিন প্রশাসনের এই সুসম্পর্ক নাও থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন৷ সাকিব আলি বলেন, ‘‘উনি (ট্রাম্প) যে সব উল্টে দেবেন তা আমি বলছি না৷ তবে বুঝতে হবে এই এলাকায় এখন বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মুখোমুখি হয়ে গেছে৷ ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তার পরিবর্তন হবে৷ মোদী ফ্যাক্টর কাজ করবে৷ কারণ ট্রাম্প আর মোদীর মধ্যে সম্পর্ক অনেক ভালো৷ তাই বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে৷''
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল(অব.) মো. শহীদুল হক বলেন, ‘‘ট্রাম্প জিতলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটি ফ্যাক্টর হবেন৷ আর ট্রাম্পের সঙ্গে তার সম্পর্কের জন্য তিনি চাইবেন বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্প যেন তার চিন্তায় চিন্তা করেন৷ সেটা পুরেপুরি হবে না৷ তারপরও মোদী চেষ্টা করবেন৷ তার প্রভাব পড়তে পারে৷ তাই বর্তমান সরকারকে রুটিন কূটনীতির মধ্যে থাকলে চলবে না৷ আরো সক্রিয় হতে হবে৷''
বিশ্লেষকদের মতে, এরইমধ্যে বাংলাদেশকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্টরা সক্রিয় আছেন৷ নির্বাচনের পর তারা আরো সক্রিয় হবেন৷ লবিস্টরা নানা বিষয়ে মার্কিন নীতিকে প্রভাবিত করতে পারেন৷
‘যেই জিতুক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে না’
তবে এই বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে বলে তারা মনে করেন না৷ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে রোববার শফিকুল আলম বলেন, ‘‘একজন বিশ্বনেতা হিসেবে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে উভয় দলের (যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টি ও ডেমোক্রেটিক পার্টি) জ্যেষ্ঠ নেতাদের অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক আছে৷''
প্রেস সচিব বলেন, ‘‘সম্পর্ক অনেকটাই নির্ভর করে ব্যক্তিগত যোগাযোগের ওপর৷ অধ্যাপক ইউনূস একজন বিশ্বনেতা৷ কমলা হ্যারিস বা ডনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন নির্বাচনে যিনিই জয়ী হোন না কেন, আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না৷’’
বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর ‘বর্বরোচিত সহিংসতার' নিন্দা জানিয়ে ডনাল্ড ট্রাম্পের পোস্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিয়ে ডনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয় এবং লবিস্টরা এই ইস্যুকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে৷’’