মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার: বার বার কেন সিন্ডিকেট?
২ জুন ২০২৪আর প্রায় পাঁচ লাখ কর্মীর কাছ থেকে অতিরিক্ত নেয়া হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য জন প্রতি সরকার ঘোষিত খরচ ৭৯ হাজার টাকা। অভিযোগ, তাদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে গড়ে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা। আগে চার বার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পর ২০২২ সালে ফের লোক পাঠানো শুরু হয়। এই দফায় মোট পাঁচ লাখ কর্মীকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি বলছে, তাদের মধ্যে ৩০ হাজার জন মালয়েশিয়া যেতেই পারেননি।
৩১ মের পর থেকে বাংলাদেশ থেকে লোক নেয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। ওই তারিখের মধ্যে যারা রেজিস্টার্ড, তাদের মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ ছিলো। কিন্তু প্রতারণার কারণে তাদের মধ্যে ৩০ হাজার জন সে দেশে যেতে পারেনি। শেষ সময়ে বিমান ভাড়া বাড়িয়ে তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়। কিন্তু সেই টিকেটও ছিলো জাল।
প্রতারিতরা যা বলছেন:
তাদেরই একজন নরসিংদির মোহাম্মদ আবু বকর। তিনি তিন দিন ঢাকায় বিমানবন্দরে অপেক্ষা করেছিলেন মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য, কিন্তু যেতে পারেননি। ১ জুন বাড়ি ফিরে গেছেন। তিনি বলেন," আমি ঋণ করে ও কিছু জমি বিক্রি করে ছয় লাখ টাকা দিয়েছিলাম ঢাকার ফকিরাপুল এলাকার এক দালালকে। কিন্তু সে এখন ফোন ধরছেনা।” তিনি জানান, ,"শেষ মুহূর্তে আমাকে বিমানের টিকেট দেয়া হয়। কিন্তু ইমিগ্রেশনে গিয়ে জানতে পারি আমার টিকেটটি জাল। টিকেটে নাম্বার নাই। তারপর তিন দিন সেখানে অপেক্ষা করে দালালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে আর পাইনি। এখন আমি কী ভাবে কী করব ভেবে পাচ্ছিনা।”
সাভারের আতিয়ার রহমানেরও একই অভিজ্ঞতা। তাকেও ইমিগ্রেশন থেকে বলা হয় তার টিকিট জাল। তিনি তার গরু আর জমি বিক্রি করে দালালকে টাকা দিয়েছিলেন সাড়ে পাঁচ লাখ। আর নরসিংদীর সবুজ মিয়া জানান," সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দেয়ার পর টিকিটের দাম বেশি বলে শেষ মুহূর্তে আমার কাছ থেকে আরো ৫০ হাজার টাকা নেয়া হয়। তারপরও আমি যেতে পরলাম না।”
মালয়েশিয়ায় গিয়ে কী হাল:
তবে মে মাসের শেষ চার-পাঁচ দিনে কয়েক হাজার লোক যেতে পেরেছেন মালয়েশিয়া। ৩১ মে পর্যন্ত পাঠানোর সুযোগ ছিলো।
যারা যেতে পেরেছেন তাদের কাছ থেকে টিকিটের দাম বেশি বলে বাড়তি এক লাখ টাকা আদায় করা হয়। তারা মালয়েশিয়ায় গিয়ে বিমান বন্দরে তিন-চারদিন আটকা ছিলেন। এখন তারা মালয়েশিয়ায় ঢুকতে পারলেও কোথায় তাদের চাকরি হবে তা তারা জানেন না। তাদেরই একজন মাগুরার রফিকুল ইসলাম শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় পৌঁছতে পারলেও তার চাকরির এখনো ঠিক নাই। তিনি জানান," আমাদের বেসাপাতুরিয়া এলাকার চার তলা ভবনে রাখা হয়েছে। আমরা এক রুমে আছি ৩১ জন। আমাদের এখানে ঠিকমতো খাবার দেয়া হয়না। দিনে এক বেলা খাবার দেয়া হচ্ছে। পানি নেই। ফ্যান নেই। তিন দিনে মাত্র এক দিন এজেন্সির লোক এসেছিলেন। বলেছেন আমরা তিন-চারদির পর কাজে যোগ দিতে পারব।”
তার কথায়, "আমরা তিনদিন এয়ারপোর্টে আটক থাকার পর ৩১ তারিখ ছাড়া পাই। আমাদের সাথের কয়েকজন এখনো এয়ারপোর্টে আটকা আছেন। দূতাবাসের কাউকে আমরা এয়ারপোর্টে দেখিনি।”
তিনি জানান," আমি সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে এসেছি। কারোর ছয় লাখ টাকাও লেগেছে। আমি আমার জমি এবং স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে এসেছি। এখন কী হবে জানিনা।”
দায় কার?
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের(বায়রা) মহাসচিব আলি হায়দার চৌধুরী জানান," আমরা এখন হিসাব করে দেখছি কত লোক যেতে পারেননি। তবে ধারণা করছি ৩০ হাজারের কম হবে না।”
মালয়েশিয়ায় এই পরিস্থিতির কারণে সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হচ্ছে। মোট ১০০টি রিক্রুটিং এজেন্সির এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দেয় প্রধান ১০টি এজেন্সি। ওই এজেন্সির বাইরে আর কেউ মালয়েশিয়ায় লোক পাঠাতে পারেনা। তাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা আছেন। পুরো চক্রটিকে পরিচলনা করে সারোয়ান নামে মালয়েশিয়ার এক সাবেক মন্ত্রী এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি আদম ব্যবাসায়ী দাতো আমিন এবং বাংলাদেশে বায়রার নির্বাহী কমিটির সদস্য রুহুল আমীন স্বপন। দাতো আমিনের মালয়েশিয়ায় "ডেস্টিনেট” নামে একটি কোম্পানি আছে । তার মাধ্যমেই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
বায়রার সহসভাপতি রিয়াজ উল ইসলাম জানান," সরকরি খরচ ৭৯ হাজার টাকা হলেও আরো বিভিন্ন খাতে টাকা আদায় করা হয়। এরমধ্যে আরে সেসব টাকা নেয় হয় তার মধ্যে আছে স্বপন সাহেবের একটি ফান্ড আছে সেখানে জন প্রতি দিতে হয় এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। ভিসা বাবদ অতিরিক্ত আরো নেয়া হয় এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা। টিকিট বাবদ এক লাখ। আরো মেডিকেলসহ বিভিন্ন খাতে ২০-২৫ হাজার টাকা নেয়া হয়। এছাড়া যারা সাব এজেন্ট তারাও অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে।”
তার অভিযোগ," এর আগেও চারবার এই সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়া লোক নেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। তারপরও বাংলাদেশ সরকার এই সিন্ডিকেটকে অনুমোদন দিয়েছে। মালয়েশিয়ায় আরো যেসব দেশ লোক পাঠায় তারা সিন্ডিকেট অনুমোদন দেয়না। একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ।”
তিনি জানান," এই সিন্ডিকেটের কারণে চাকরি ছাড়াই অনেককে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। ভুয়া কোম্পানির নামে পাঠানো হয়েছে। ফলে অনেকে সেখানে গিয়ে কাজ পায়নি। আর সিন্ডিকেট পাঁচ-ছয় গুণ বেশি টাকা নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মালয়েশিয়া লোক নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। যারা এরজন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে আগেও সমরকার ব্যবস্থা নেয়নি। এখনো নিচ্ছেনা। ”
তবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেছেন," মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে যারা সংকট তৈরি করেছেন তাদের ছাড় দেয়া হবেনা। মন্ত্রণালয় ও দূতাবাস তাদের চিহ্নিত করতে কাজ করছ। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
তিনি আরো বলেন," যারা যেতে পারেননি তাদের বায়রা টাকা ফেরত দেবে।”
কিন্তু বায়রা সহসভাপতি বলেন," আমরা কেন দেব? যারা প্রতারণা করেছে তারা দেবে। তাদের বিরুদ্ধে সরকার কেন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা? এখানে অনেক প্রভাবশালী এই অর্থের ভাগ পায়। তাদেরও চিহ্নিত করা হোক।”
কী করছে দূতাবাস:
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর সৈয়দ শরিফুল ইসলাম জানান," কী কারণে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করেছে সেটা আমাদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। তবে তারা সব দেশ থেকেই নেয়া বন্ধ করেছে। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। চেষ্টা করছি যাতে আবার তারা বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া শুরু করে। আলাপ-আলোচনা চলছে।”
তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন," যারা ৩১ তারিখ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরে এসে আটকে ছিলেন তারা সবাই মালয়েশিয়া ঢুকতে পেরেছেন। আমরা দূতাবাস থেকে বিমানবন্দরে গিয়ে তাদের সহায়তা করেছি। তারা যাতে কোনো সমস্যায় না পড়েন সেদিকে আমরা খেয়াল রাখছি।”
তিনি জানান মালয়েশিয়ায় এখন আনুমানিক ১২ লাখ বাংলাদেশি আছেন। তবে একদম সঠিক সংখ্যা বলা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি। সিন্ডিকেটের প্রশ্নে তিনি বলেন," মালয়েশিয়ার সরকার শ্রম বাজার বন্ধের কোনো কারণ আমাদের জানায়নি। ফলে আমাদের পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়।”
তবে বায়রার মহাসচিব আলি হায়দার চৌধুরী বলেন," মালয়েশিয়ায় যারা লোক পাঠিয়েছে তাদের মধ্যে অনেক ব্ল্যাকলিস্টেড কোম্পানি আছে। আবার ভুয়া কোম্পানির নামেও অনেককে পাঠানো হয়েছে। তারা ওখানে গিয়ে কাজ না পেয়ে সমস্যা তৈরি করছে। সব মিলিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে।”
তার কথা," এই বিষয়টিতে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা লোক পাঠাইনি। কিছু নির্দিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্ট কাজ করেছে। এই দায়-দায়িত্ব তাদের। ১০০ কোম্পানির সঙ্গে আরো কিছু কোম্পানি রিক্রুটমেন্টের কাজ করেছে সহযোগী হিসেবে। আমাদের সদস্য সংখ্যা দুই হাজার ৪০০। তারমধ্যে অনেকেই এই কাজের সঙ্গে যুক্ত নই।”
মালয়েশিয়ায় বালাদেশী কর্মীদের বিষয়টি পুরো নিয়ন্ত্রণ করে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি নাগরিক দাতো আমিনের "ডেস্টিনেট”। ওই প্রতিষ্ঠানই সব ঠিক করে। আর বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণ করে বায়রার সদস্য রুহুল আমীন স্বপন। এনিয়ে কথা বলার জন্য বার বার চেষ্টা করেও রুহুল আমীন স্বপনকে পাওয়া যায়নি।