মিষ্টি স্বাদে, মিষ্টি আধ্যাত্মবাদে
৮ মে ২০১৮জার্মানি কেন, ইউরোপ যতটা ঘুরেছি একটাও মিষ্টির দোকান খুঁজে পেলাম না৷ মানে ঐ যে পাড়ার মোড়ে আধবুড়ো কেউ জামার দু'টো বোতাম খুলে কাঁচাপাকা বুকের লোমগুলো নিয়ে বসে আছেন ছোট্ট একটা কাউন্টারের ওপার৷ পাশে একটা হাতপাখা৷
ভেতরে কাঠের টেবিল আর বেঞ্চি৷ তারওপরে আধবুড়ো কাকাটার মতোই আধবুড়ো একটা বা দু'টো ফ্যান অনিচ্ছুক ঘুরছে ওপরে৷ নীচে ঐ বেঞ্চিগুলোতে কয়েকজন বেশ রসিয়ে রসিয়ে ফর্সা রঙের রসগোল্লার পেটে চামচ চালিয়ে দিচ্ছেন সতর্কভাবে৷ গরম ছানাময় মিষ্টির টুকরোটা মুখে পুরে দিয়ে বন্ধ চোখে যেন গলনালী দিয়ে তা পাকস্থলী পর্যন্ত চালান করে দেয়া পর্যন্ত হিসেব বুঝে নিচ্ছেন৷ কেউ কেউ আবার হলদে নোনতা নিমকির মাঝবরাবর কামড়ে দিয়ে স্বাদের এক অপূর্ব ভারসাম্য রক্ষায় ব্যস্ত৷
কম বয়সি দোকানিরা যেমনি ব্যস্ত এই রসিক ক্রেতাদের মনভোজনের আয়োজনে, তেমনি কারো কারো দম ফেলবার সময় নেই, দাঁড়িয়ে থাকা অন্যদের সাদা, লাল, কালো মিষ্টির চারকোণা প্যাকেটের আবদার মেটাতে মেটাতে৷
জার্মানিতে কেন নেই, এই দুঃখে চোখে জল আসার কথা৷ কিন্তু আমার জল আসে জিভে, যখনই দেশের মিষ্টিগুলোর কথা মনে পড়ে৷ কল্পনায় রসমালাই, ছানামুখী, রসগোল্লা কিংবা প্যাড়া আর ঝুরা সন্দেশের গন্ধে আমি মাতাল হই৷
অনেক লেখায় পড়েছি, যেই মিষ্টি আমাদের এতটা উতলা করে, সেটি বা সে জাতীয় খাবারের বিস্তারে বিরাট ভূমিকা রেখেছে ভারতবর্ষ৷ এখনো মিষ্টিতে এতটা বৈচিত্র্য আর কোথাও নেই৷
কনফেকশনারির ইতিহাস নিয়ে একবার যুক্তরাজ্যের ডেইলি মিরর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল৷ সেখানে কনফেকশনারি গবেষক টিম রিচার্ডসন মিষ্টির ইতিহাসের একটি টাইমলাইন তুলে ধরেছিলেন৷ তাঁর মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০০ অব্দে যখন গুহামানবেরা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তখনই মিষ্টিস্বাদের সঙ্গে পরিচিত হয় মানুষ৷ তবে তা এখানে নয়, ভ্যালেন্সিয়াতে৷ সেখানকার গুহাচিত্র গবেষণা করে দেখা যায়, তখনই মানুষ টের পেয়ে যায়, যে মৌচাকের ভেতরে মৌ মৌ করা মধু আসলে এক অমৃত বস্তু৷
কিন্তু মধু তৈরি করতে হয় না৷ তৈরি করা মিষ্টি সম্ভবত পৃথিবীকে প্রথম চিনিয়েছে ভারতবর্ষই৷ ‘সুগার' শব্দটিরই তো উৎপত্তি সংস্কৃত ‘শর্করা' শব্দ থেকে৷ এমনকি ‘ক্যান্ডি' শব্দটিও এসেছে সংস্কৃত ‘খান্ডা' শব্দ থেকে৷ শর্করা হলো, পরিশোধিত চিনি৷ আর খান্ডা হলো অপরিশোধিত চিনি৷
চিনির পরিশোধনও সম্ভবত ভারতবর্ষের লোকেরাই শিখিয়েছে পৃথিবীকে৷ খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ অব্দে তৎকালীন হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর লোকেরা এই মহৎ কাজটি পারতেন বলে কেউ কেউ মনে করেন৷ তখন ব্রোঞ্জ যুগ৷ তবে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দ থেকে ৩০০ অব্দ নাগাদ যে এখানে নানান রকমের পরিশোধিত চিনি (শুধু আখ থেকে নয়) প্রস্তুত হতে শুরু করে, তার পরিষ্কার প্রমাণ রয়েছে৷ এ সময়টাতেই ভারতবর্ষের প্রথম মিষ্টি মতিচুরের লাড্ডু তৈরি হয়৷ তবে তা দুধ থেকে নয়৷
‘মিঠাস'-এর ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে আদি সংস্কৃত সাহিত্যে৷ পরবর্তী সংস্কৃত টেক্সট, যেগুলো বেশ অনেকটাই অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে, সেখানে মিষ্টান্নের ব্যাপক উল্লেখ পাওয়া যায়৷ ১১৩০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা সোমেশ্বর (তৃতীয়) ‘মানসোল্লাস' সংকলন করেন৷ সেখানে পায়েসাম (পায়েস বা ক্ষীর)-এর উল্লেখ আছে, যাতে সাত রকমের চাল ব্যবহার করা হতো৷ আরো উল্লেখ আছে ‘গোলামু' নামের আরেক মিষ্টি জাতীয় খাবারের, যেটি বর্তমান সময়ের ডোনাটের মতো, ময়দা ও চিনির সিরায় তৈরি হতো৷ পনির ও চালের গুড়া দিয়ে তৈরি করা হতো ‘চানা'৷ এমন আরো অসংখ্য মিষ্টি জাতীয় খাবারের কথা রয়েছে৷ এতেই বোঝা যায়, এ অঞ্চলে মিষ্টির যে বাহার তার সূচনা সুঅতীতেই হয়ে গেছে৷
পরবর্তীতে মিষ্টি নানা রূপ নিয়েছে৷ ভারতবর্ষের একেক অঞ্চলে একেক রকমের ডালপালা মেলেছে৷ বাংলায় নানান মিষ্টান্ন আগেই তৈরি হলেও আধুনিক সন্দেশ-রসগোল্লার বয়স দুই-আড়াই'শ বছরের বেশি নয়৷
বৈষ্ণবদের নিরামিষ খাবারে বৈচিত্র্য ও স্বাদ আনতেই প্রথম এ অঞ্চলে দুধের তৈরি নানান মিষ্টিজাতীয় খাবার পরিবেশন করা হতো৷ বৈদিক যুগে দুধ ও দুধ থেকে তৈরি ঘি, দধি, মাখন ইত্যাদি ছিল দেবখাদ্য৷ মহাভারত অনুযায়ী ননি ও মাখন প্রিয় ছিল শ্রীকৃষ্ণের৷ এ জন্য দুধ থেকে রূপান্তরিত ওই সব খাদ্য শ্রেষ্ঠ বলেই বিবেচিত হতো৷
প্রথম দিকে ছানা ও ছানার মিষ্টি একরকম ব্রাত্য ছিল৷ ড. সুকুমার সেন তাঁর কলিকাতার কাহিনি বইয়ে লিখেছেন, ‘‘ক্ষীর-মাখন-ঘি-দই –এগুলো কাচা দুধের স্বাভাবিক পরিণাম, কৃত্রিম অথবা স্বাভাবিক৷ কিন্তু কোনোটিই দুধের বিকৃতি নয়৷'' ‘ছানা' কিন্তু ফোটানো দুধের কৃত্রিম বিকৃতি৷ বাঙালি অন্য দ্রব্য সংযোগ করে দুধ ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, যাতে সারবস্তু ও জলীয় অংশ পৃথক হয়ে যায়৷ এভাবে দুধ ছিন্নভিন্ন করা হয় বলেই এর নাম হয়েছিল বাংলায় ‘ছেনা', এখন বলা হয় ‘ছানা'৷ সংস্কৃত ভাষায় ছানার কোনোরকম উল্লেখ নেই৷ অন্য ভাষাতেও ছিল না৷ আগে অজ্ঞাত ছিল বলেই শাস্ত্রসম্মত দেবপূজায় ছানা দেওয়ার বিধান নেই৷
নীহাররঞ্জন রায়ের লেখাতেও ছানার কোনো মিষ্টির উল্লেখ নেই৷ তিনি বলেছেন, ‘‘কোজাগর পূর্ণিমা রাত্রে আত্মীয়-বান্ধবদের চিপিটক বা চিঁড়া এবং নারিকেলের প্রস্তুত নানা প্রকারের সন্দেশ পরিতৃপ্ত করিতে হইত এবং সমস্ত রাত বিনিদ্র কাটিত পাশা খেলায়৷''
চিনির সঙ্গে ছানাযোগে আধুনিক সন্দেশ ও রসগোল্লার উদ্ভাবন অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে৷ ভূবনজয়ী রসগোল্লার উৎপত্তি কোথায় তা নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা বাংলাকেই পেটেন্ট দেয়া হয়েছে৷
আদি সংস্কৃতি সাহিত্যে মূলত ভোজ ও ভোগ এই দুই উপলক্ষ্যে মিষ্টির ব্যবহারের উল্লেখ আছে৷ তাই ধর্মীয় ও সামাজিক সব উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ মিষ্টি৷ ঈদ-পূজা থেকে শুরু করে সব ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মিষ্টি অপরিহার্য৷ নববর্ষসহ নানা পার্বনে মিষ্টি ছাড়া চলবেই না৷ বিয়ে করতে যাবেন? মিষ্টি ছাড়া কনের মুখদর্শনটিও হবে না৷ রাজনৈতিক জয় পরাজয়ের হিসেবটিও জেনে যাবেন কোন পক্ষের সমর্থকদের মুখ থেকে রস গড়িয়ে পড়ছে তা দেখেই৷ পরীক্ষার ফল বেরুলে সবার বাসায় বাসায় মিষ্টি পৌঁছে দেয়া এখনো রেওয়াজ৷
এমনকি বাঙালি মিষ্টি শুধু খাবারের নামই রাখেনি, স্বাদের নামটিও মিষ্টিই রেখে দিয়েছে৷ আর কোনো স্বাদের সঙ্গে কিন্তু এই সংযোগটি নেই৷
আমি একে অ্যালিগরিকালি দেখতে চাই৷ এই মিষ্টিকে বাঙালি এতটাই ভালোবেসেছে যে এতে কোনো ছাড় দিতে তারা রাজি নয়৷ অতিথি আপ্যায়ন বা ধর্মীয় অনুষঙ্গ থেকে শুরু করে যে কোনো শুভ কাজের সঙ্গে মিষ্টিকে জুড়ে দিয়ে বাঙালি এই খাবার বা স্বাদটিকে তাদের মননে একটি পবিত্র ও শুদ্ধ জায়গা দিয়েছে, যা আর কোনো খাবারকে দেয়নি৷ তাই শুধু রসনাতেই আটকে থাকেনি মিষ্টি, অজান্তেই এর মধ্যে আধ্যাত্মবাদও জুড়েছে আষ্টেপৃষ্টে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷