মিয়ানমার আসলে কী চায়?
৩ অক্টোবর ২০১৭মিয়ানমারের রাখাইন থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা আগের তুলনায় কিছুটা কমে এলেও বন্ধ হয়নি৷ প্রতিদিন এখনো গড়ে এক-দেড় হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু বাংলাদেশে প্রবেশ করছে৷ গত এক সপ্তাহে সাত হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে৷ যারা আসছেন, তারা বলছেন, এখনো নির্যাতন চলছে৷ বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়া হচ্ছে৷ রোহিঙ্গাদের চলে যাওয়ার জন্য রাখাইনে মাইকিং করা হচ্ছে৷ কক্সবাজারের সাংবাদিক আব্দুল আজিজ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘গত তিন দিন আমরা সীমান্তের এপার থেকে ওপারের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে আগুন জ্বলতে দেখেছি৷ এমনকি আজও (মেঙ্গলবার) আগুন জ্বলতে দেখা যায়৷''
তিনি বলেন, ‘‘এখন রোহিঙ্গারা শাহপরী দ্বীপসহ আরো কিছু সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করছেন৷ কৌশল হিসেবে তাঁরা রাতের বেলায় প্রবেশ করেন৷ আজও ( মঙ্গলবার) কমপক্ষে এক হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রবেশ করেছেন৷ যাঁরা আসছেন তাঁরা বলছেন যে, রাখাইনে নির্যাতন এখনো চলছে৷ বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়া হচ্ছে৷ রোহিঙ্গাদের রাখাইন ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য মাইকিং অব্যাহত আছে৷''
২৫ অগস্ট থেকে নির্যাতনের মুখে এ পর্যন্ত পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন৷ মিয়ানমারের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল নিউ লাইটকে উদ্ধৃত করে ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, ‘‘বাংলাদেশে ঢোকার জন্য রাখাইনের পশ্চিমাঞ্চলের দুই গ্রামের মধ্যবর্তী সীমান্তের কাছে ১০ হাজারেও বেশি মানুষ জড়ো হয়েছেন৷ তাঁরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন৷''
তবে মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো সরকারের মুখপাত্র গ্লোবাল নিউ লাইট তাদের প্রতিবেদনে দাবি করেছে, ‘‘কর্তৃপক্ষ পালিয়ে যেতে চাওয়া রোহিঙ্গাদের বারবার আশ্বস্ত করতে চাইছে যে, রাখাইনে তারা এখন নিরাপদ৷ তা সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা নিজেদের ইচ্ছায় বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে৷'' কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের নিজস্ব অনুসন্ধানের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ‘‘গ্রামবাসী ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভুগছে৷ বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা ক্রমাগত তাঁদের হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে৷''
নিজেদের গ্রাম থেকে রাখাইন বৌদ্ধঅধ্যুষিত গ্রামগুলো পার হয়ে যেতেও ভয় পাচ্ছে রোহিঙ্গারা৷ রোহিঙ্গা অ্যাডভোকেসি গ্রুপ আরাকান প্রজেক্টের প্রতিনিধি ক্রিস হ্যারিস এএফপিকে বলেছেন,‘‘ গ্রামপ্রধান যদি গ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন, সঙ্গে সঙ্গেই সমগ্র গ্রামবাসী সেই সিদ্ধান্ত মেনে গ্রাম শূন্য করে পালিয়ে যায়৷''
সোমবার ঢাকায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার প্রস্তাব দেয় মিয়ানমার৷ তবে মিয়ানমার বলছে, তারা ২৫ অগাষ্ট থেকেবাংলাদেশে যারা এসেছেতাদের যাচাই-বাছাই করে ফেরত নেবে৷ কিন্তু এর আগে আরো যে চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে, তাদের ব্যাপারে মিয়ানমার নীরব৷ সূত্র বলছে, এই যাচাই-বাছাইও মিয়ানার এককভাবে করতে চায়৷ কিন্তু বাংলাদেশ চায় তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতে মিয়ারমার- বাংলাদেশ যৌথভাবে তা করুক৷ আর মিয়ানমার যদি তাদের দেয়া নাগরিকত্বের কার্ড শুধু বিবেচনা করে, তাহলে সেরকম রোহিঙ্গার সংখ্যা সাত হাজারের বেশি হবে না৷ একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু তার রূপরেখা এখনো চূড়ান্ত নয়৷ বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া হোক , রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ হোক এবং কোফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়িত হোক৷
সহিংসতা অব্যাহত রাখা ছাড়াও মিয়ানমার এরইমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তাদের আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা জমি-বড়ি-ঘর রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণ করবে৷ এমনকিরোহিঙ্গাদের মধ্যে যাঁদের ফেরত নেবে, তাঁদের ‘উন্মূক্ত কারাগারে' রাখা হবে৷ তাই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও সতর্ক পর্যবেক্ষণে রেখেছে ঢাকা৷
নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ (অব.) ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মিয়ানমারের মন্ত্রী ( টিন্ট সোয়ে) রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন৷ এটাকে সরলভাবে দেখার কোনো সুযোগ নাই৷ তারা আন্তর্জাতিক চাপের মুখে একটি কৌশল নিয়েছে৷ তাই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার যে প্রস্তাব তারা দিয়েছে৷ এটাকে আমি দেখছি চাপ কমানোর একটি কৌশল হিসেবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘মিয়ানমারের কথায় আস্থা স্থাপনের এখনো কোনো যুক্তি নাই৷ কারণ, দেশি এবং বিদেশি সংবাদ মাধ্যম যে খবর দিচ্ছে, তাতে রাখাইনে নির্যাতন ও সহিংসতা বন্ধ হয়নি৷ সেটা অব্যাহত আছে৷ এমনকি সোমবার বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠকের সময়ও সেখানে সহিংসতা হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়৷ তাই মিয়ানমার যে মুখের প্রস্তাব দিয়েছে, মনের প্রস্তাব নয়, তা সহজেই বোঝা যায়৷ কিন্তু চাপ অব্যাহত রাখা গেলে শেষ পর্যন্ত মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাধ্য হবে৷''
সাবেক সামরিক কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ আরো বলেন, ‘‘মিয়ানমারে সহিংসতা চালাচ্ছে সেনাবাহিনী। কথা বলছে সিভিল প্রশাসন, যারা সেনাবাহিনীর ওপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম নয়৷ কিন্তু যদি দ্বিপাক্ষিক এবং আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত এবং আরো জোরদার করা যায়, তাহলে সেনাবাহিনীরও অবন্থানের পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি৷ কারণ, এই পর্যায়ে চাপের মুখেই মিয়ানমার তার অবস্থান পরিবর্তন করছে৷ এটাকে কার্যকর পরিবর্তনে রূপ দিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে চাপে ফেলতে হবে৷''