মিয়ানমার ইস্যুতে বাংলাদেশ: পররাষ্ট্র আছে, নীতি নাই
৩১ মার্চ ২০২১নির্বাচিত সরকারকে হঠিয়ে ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী৷ এরপর থেকে দেশটিতে গণতন্ত্রকামীদের আন্দোলন চলছে৷ নানা দেশ নানাভাবে তাদের উদ্বেগ জানাচ্ছে৷ তবে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশের জন্য এই ঘটনা বিশেষ নজরে রাখার মতো৷
এরই মধ্যে বিভিন্ন শহরে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচ শতাধিক আন্দোলনকারী৷ সবচেয়ে বেশি রক্তাক্ত দিন ছিল শনিবার- ২৭ মার্চ৷ আর সেদিনই ছিল মিয়ানমারের সশস্ত্র দিবস৷
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে বিশ্বের অন্যসব দেশ যখন হয় সাধারণ মানুষ হত্যার জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে অথবা অন্তত চুপ থাকছে তখন আরো সাতটি দেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণে সশস্ত্র বাহিনীর উৎসবে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি৷ বাকি দেশগুলো হচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, লাওস, থাইল্যান্ড, চীন৷
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কেবল চলমান হত্যাকাণ্ডই নয়, রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগও রয়েছে৷ এই অভিযোগে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলাও চলছে৷ সেই সেনাবাহিনীই যখন নিজেদের জনগণের ওপর হামলে পড়ে তখন অন্য দেশগুলোর বয়কটের মুখেও সেখানে হাজির হওয়ার মানে সেনাশাসনকেই স্বীকৃতি দেয়া৷
এটা কেবল বাংলাদেশের নিজের সিদ্ধান্তের বিষয় নয়৷ রোহিঙ্গা ইস্যু যতটা না আন্তর্জাতিক, তার চেয়েও বেশি আঞ্চলিক৷ মিয়ানমারের উপকূলের বন্দর, নানা খনিজ সম্পদ, ইত্যাদি দুই বিবদমান আঞ্চলিক শক্তি চীন ও ভারতের কাছেই আকর্ষণীয়৷ ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুখে বড় বড় কথা বললেও সবসময়ই মিয়ানমারকে আগলে রেখেছে এই দুই দেশই৷
আমরা অনেকবার আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও অন্য কর্মকর্তাদের কাছে শুনেছি ‘মিয়ানমারকে চাপ দেয়ার জন্য ভারত রাজি হয়েছে', 'চীনের মাধ্যমে মিয়ানমারকে চাপ দেয়া হবে' ইত্যাদি৷ কিন্তু বাস্তবে চীন-ভারত কারো কাছ থেকেই এ বিষয়ে কোনো চাপই মিয়ানমারকে অনুভব করতে হয়নি৷ বরং অন্য যেসব দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী দিবসে হাজির হয়েছে, তারা নানা সময়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে অপ্রকাশ্য়ে সমর্থনই করে গেছে৷
কোনো যৌক্তিক কারণেই বাংলাদেশের এই আয়োজনে যোগ দেয়ার কথা না৷ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান ক্ষমতা দখলের পরপরই ‘রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের' আশ্বাস দিয়েছেন৷ তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় যে সেনাবাহিনী নিজের জনগণের এক অংশের ওপর জাতিগত সহিংসতা চালাতে পারে, নিজেরা পূর্ণ ক্ষমতায় থাকলে তারা রোহিঙ্গাদের ভালোবেসে বুকে টেনে নিবে? এটা কেউ বিশ্বাস করবে?
সেনাশাসনের ভিত্তি মজবুত করতে এমন নানা চেষ্টাই করে যাচ্ছে মিয়ানমার৷ তবে এখন পর্যন্ত চাপ বাড়ছিলোই৷ হঠাৎই মরুভূমিতে জলের ধারা নিয়ে হাজির হলো বাংলাদেশসহ আট দেশ৷
কিন্তু তাতে বাংলাদেশের স্বার্থটা কী? চীন ও ভারতের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়া? নাকি অন্য কোনো হিসাবনিকাশ? যেটাি হোক, নৈতিকতার দৃষ্টিতে এই অবস্থান কতটা সঠিক?
যখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলা চলছে, তখন সেই দখলদার ও হত্যাকারী সেনাবাহিনীর উৎসবের দাওয়াতে যোগ দেয়া মানে তার অপকর্মকে স্বীকৃতি দেয়া, সেটা কি এত অভিজ্ঞ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানে না? অবশ্যই জানে৷
অন্যদিকে বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে ‘আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন' বলা হয়েছে, যেকোনো সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন৷ বাংলাদেশ কি মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী দিবসের আয়োজনে অংশ নিয়ে সেটাই করলো? নাকি নিপীড়িত জনগণকে আরো নিপীড়ণের অধিকার সেনাবাহিনীকে দিয়ে এলো?