রোহিঙ্গা ইস্যুতে চুপ কেন মোদী?
৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭মোদীর এই সফর নিয়ে যাঁরা আশা করে বসেছিলেন যে তিনি রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে কিছু একটা বলবেন, তাঁরা আশাহত হয়েছেন৷ তাঁরা মোদীর এই ‘চুপ থাকার কূটনীতি' নিয়ে এখন হিসেব করছেন৷ সেই হিসেবে দেখা যাচ্ছে – প্রধানত অর্থনীতি, ভূ-রাজনীতি এবং দলীয় নীতির কারণেই মোদী রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখাননি৷ বরং মোদীর কাছে গুরুত্ব পেয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ স্বার্থ৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গা নয়, মিয়ানমার এখন ভারতের কাছে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ৷ তাই মিয়ানমারকে না চটিয়ে এই সফরে দেশটিকে আরো কাছে টানতে তৎপর ছিলেন মোদী৷ তিনি মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷ ইয়াঙ্গুনের কালীমন্দিরে গেছেন, পুজোও দিয়েছেন৷
ভারত নাকি এখন ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড – ত্রিদেশীয় হাইওয়ে প্রকল্প নিয়ে স্বপ্ন দেখছে৷ আর তার জন্য প্রথম যাকে লাগবে, সেই দেশটি হলো মিয়ানমার৷ আসিয়ান জোটের দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতেও প্রথম যাকে ভারতের দরকার, সে দেশটিও হলো মিয়ানমার৷ বিসটেক জোটেও ভারতের সহযোগী মিয়ানমার৷ তাই ‘কানেকটিভিটি' এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে মিয়ানমার ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷
বলা বাহুল্য, মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এখন ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ মিয়ানমারে কায়াখফু বন্দর তৈরি করে দিচ্ছে চীন৷ এছাড়া দু'দেশের মধ্যে গ্যাস লাইন বসানোর কাজও চলছে৷
অন্যদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য দিয়ে ভারত প্রায় ৫০ কোটি ডলার খরচ করে ‘কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রান্সপোর্ট প্রোজেক্ট'-এর কাজ করছে৷ এই ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল আর বঙ্গোপসাগরের মধ্যে সরাসরি সংযোগ গড়ে তুলবে৷ ভারতের টার্গেট – বাংলাদেশ যদি কখনো ভারতকে ট্রানজিট দিতে অস্বীকার করে, তাহলে মিয়ানমারের মধ্য দিয়েই হবে ট্রানজিট৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মিয়ানমারকে চটানোর কোনো কারণ নেই ভারতের৷ তারা চীনের কারণে মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়৷ বঙ্গোপসাগরে ভারতের বড় স্বার্থ আছে৷ আর ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যও মিয়ানমার ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ৷''
তিনি বলেন, ‘‘মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরেই চীনের প্রভাব বলয়ে আছে৷ ভারত চাইছে সেই প্রভাবটা হালকা করে দিতে৷ ভারতের কাছে ভূ-রাজনৈতিকভাবে মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ৷ বাংলাদেশেরও গুরুত্ব আছে৷ তবে তা মিয়ানমারকে বাদ দিয়ে নয়৷ তাই মিয়ানমার নিয়ে বাংলাদেশের কোনো প্রত্যাশা আছে কিনা, মোদী সেটা মাথায় রাখার প্রয়োজন মনে করেননি৷''
অধ্যাপক মজুমদার মনে করেন, ‘‘বিজেপির নীতির সঙ্গেও চমৎকার মিলে গেছে মোদীর এই আচরণ৷ বিজেপি একটি সাম্প্রদায়িক দল৷ তাই মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমান নির্যাতন নিয়ে মোদীর কথা না বলাটাই স্বাভাবিক৷''
অন্যদিকে ভারতের ইকনমিক টাইমস-এর ডিপ্লোম্যাটিক এডিটর দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মিয়ানমার সফরে নরেন্দ্র মোদী রোহিঙ্গাদের নিয়ে কথা বলেছেন৷ তবে কথাগুলো তিনি ভিন্নভাবে বলেছেন৷''
দীপাঞ্জন রায় চৌধুরীর কথায়, ‘‘ভারত-মিয়ানমারের যৌথ সমঝোতা স্মারকটা দেখলে বোঝা যায় যে ভারত রোহিঙ্গাদের কথা একটু ঘুরিয়ে বলেছে৷ কারণ বাংলাদেশ যেভাবে দেখবে ভারতের কাছে বিষয়টি সেরকম হবে, সেটা আশা করা যায় না৷ ভারত বলেছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি কীভাবে করা যায় যাতে ‘মাইগ্রেশন' না হয়৷ এ নিয়ে যৌথভাবে কিছু কাজ করার কথাও হয়েছে৷ তাই উনি (মোদী) যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোনো কথা বলেননি, এটা বলা ভুল৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘কালাদান মাল্টি-মোডাল প্রজেক্ট, ত্রিদেশীয় হাইওয়ে, ভারতের উত্তর-পূর্বের সঙ্গে মিয়ানমারে আরো একটি যোগাযোগ প্রকল্প রয়েছে৷ এগুলো ২০২১ সালের মধ্যে শেষ করার তাগিদ আছে৷ এই সফরে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তও হয়েছে৷''
ভারতের বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘‘বঙ্গোপসাগর ছাড়াও মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের ১৬৪৩ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত আছে৷ এই সীমান্ত অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও মিজোরাম – এই চারটি রাজ্য জুড়ে, যার অন্য প্রান্তের গহীন জঙ্গলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেক জঙ্গি গোষ্ঠীরই ঘাঁটি রয়েছে৷ তাই মিয়ানমারের সহযোগিতা ভারতের প্রয়োজন৷''
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ভারতের এই অবস্থানকে আপনি কীভাবে দেখছেন? লিখুন নীচের ঘরে৷