মুক্তিযোদ্ধা আসল নকল
১১ ডিসেম্বর ২০১৭১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাসের অনিল চক্রবর্তী ছিলেন তরতাজা যুবক৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনিল চক্রবর্তী ভারতের শিলিগুড়িতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন৷ এরপর মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন৷ ৭নং সেক্টরে কমান্ডার বাগ-বাগিচা,আরঘাটা হাট ও রংপুর রেল স্টেশন এলাকায় পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেন৷ ছিনিয়ে আনেন স্বাধীনতা, লাল-সবুজের পতাকা৷ সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চক্রবর্তীর বয়স এখন ৬৬ বছর৷ রিকশা চালিয়ে কোনোভাবে জীবন ধারণ করছেন৷ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার মধ্যম গাছবাড়িয়ার ৫-৬ জনের সংসার আর তিনি টানতে পরছেন না৷ তবুও জীবন যতদিন আছে রিকশার প্যাডেল তো আর থামাতে পারবেন না৷
মুক্তিযোদ্ধার মানবেতর জীবন লিখে সার্চ ইঞ্জিন গুগলে সার্চ দেয়ার পর এর ওপর ৭১ হাজার ৫০০ লিংক পাওয়া যায়৷ সেই সব লিংকে আছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনযুদ্ধ, অবহেলা, অপমান আর বঞ্চনার কথা৷ শুরুতে বর্ণনা করা মুক্তিযোদ্ধা অনিল চক্রবর্তীর জীবন কাহিনি তারই একটি৷ কিন্তু অনেকের কথা সংবাদমাধ্যমে হয়ত প্রকাশ হয় না৷ অনেকের ঘটনা আসে না আলোচনায়৷ আর আসলেই বা কী করে? তাতে কি অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা বদলাবে?
এর বিপরীতে এখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধরা আলোচনায়৷ আছে মুক্তিযোদ্ধার জাল সার্টিফিকেট৷ ২০১৬ সালে যশোরের চৌগাছায় ১৫৪ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা শনাক্ত হয়৷ এ রকম আরো অনেক জেলা উপজেলায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার কথা সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই ছাপা হয়৷ এ সম্স্ত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধরা সরকারি ভাতা ও সুবিধাও নিচ্ছেন৷ বিষয়টি নিয়ে খোদ মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও বিপাকে আছে৷ অর্থমন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার ওপর জোর দিয়েছে৷ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা না পাঠালে তাঁদেরও সম্মানী ভাতা বা উৎসব ভাতা দেওয়া হবে না বলেও জানানো হয়েছে৷ প্রসঙ্গত, এই তালিকা পাঠানোর কথা ছিল গত মে মাসের মধ্যে৷
গত ১২ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি করতে একটি গেজেট প্রকাশ করে৷ সারা দেশের আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ৪৮৮টি উপজেলা এবং ৮টি মহানগর কমিটি কাজ শুরু করে ২১ জানুয়ারি৷ তালিকাভুক্ত ২ লাখ ৩০ হাজার সদস্যের মধ্যে কারা ভুয়া এবং কাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন, তার জন্য সারা দেশে কমিটি করা হয়৷ কিন্তু তাদের কাজ নিয়েও অভিযোগ ওঠে৷ অভিযোগ ওঠে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত করা এবং তালিকা থেকে বাদ দেয়ার৷ শতাধিক কমিটির সদস্যদের অভিযোগ ওঠার পর ৩৫টি উপজেলার ৪৫টি কমিটি পুনর্গঠন করা হয়৷
সাত সদস্যের কমিটিতে প্রধান করা হয় স্থানীয় সংসদ সদস্যকে৷ বেশকিছু উপজেলার কমিটিতে সংশ্লিষ্ট উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে রাখা হয়নি৷ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার এই অনিয়মের অভিযোগ তুলে হাইকোর্টে রিট করা হলে হাইকোর্ট যাচাই-বাছাই স্থগিতের নির্দেশ দেয়৷ তারই প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই স্থগিত করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)৷ তবে ১২ এপ্রিল উচ্চ আদালত এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে আবার যাচাই বাছাইয়ের কাজ শুরু হয়৷ এ পর্যন্ত ৪৭০টি উপজেলার মধ্যে ৩৬০টি উপজেলার তালিকা চূড়ান্ত করা হলেও তাতে রয়েছে অনেক অসঙ্গতি এবং ভুল৷ আইনি জটিলতায় ১১০টি উপজেলার তালিকা এখনো চূড়ান্ত হয়নি৷ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হতে ইচ্ছুক প্রায় দেড় লাখ ব্যক্তির আবেদন এবং গেজেটভুক্ত ৪৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে ওঠা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের আওতায় আনা হয়েছে৷
চূড়ান্ত প্রতিবেদনে অনেকক্ষেত্রেই সাক্ষীদের বর্ণনা এবং প্লাটুন কমান্ডার ও গ্রুপ কমান্ডারদের সঙ্গে চূড়ান্ত ‘মন্তব্য'-এর মিল নেই৷ আবার সাক্ষীসহ অন্যরা যে ব্যক্তির কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন, সেই ব্যক্তিকেই চূড়ান্ত ফলাফলে ‘মুক্তিযোদ্ধা নন' বলা হয়েছে৷ অধিকাংশ উপজেলা থেকে পাঠানো অসংখ্য প্রতিবেদনে আবেদনকারী ব্যক্তির নাম ও ঠিকানায়ও রয়েছে অসংখ্য ভুলত্রুটি৷
গত ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত জামুকায় ২৯ হাজার ৮০৭টি আপিল জমা পড়েছে৷ প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়ছে৷ এ সব আপিল নিষ্পত্তিতে শিগগির কমিটি গঠনেরও কোনো উদ্যোগ নাই৷
প্রতিবেদনে অসঙ্গতি ও ভুলত্রুটি চ্যালেঞ্জ করে ইতিমধ্যে হাইকোর্টে কয়েকটি রিটও করেছেন অনেকে৷ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, এ ধরনের ১১৩টি রিট এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন৷
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন-২০০২ অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার ক্ষমতা জামুকার৷ এর আগে হাইকোর্টের নির্দেশে দু'বছর বন্ধ থাকার পর গত ২১শে জানুয়ারি যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু হলেও তা আরেক দফা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে৷ শেষ পর্যন্ত তা কাটিয়ে এখনো যাচাই-বাছাই শেষ হয়নি৷ কবে হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না৷
এদিকে স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও বীরাঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি৷ ২০১৫ সালের অক্টোবরে সরকার গেজেটের মাধ্যমে ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করে৷ এর পরের বছর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয় আরো ২৩ জন বীরাঙ্গনাকে৷ কিন্তু আরো অনেক বীরাঙ্গনা এখানো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি৷ যাঁরা এতবছর পর স্বীকৃতি পেয়েছেন, তাঁরা সরকারি কিছু ভাতা পান৷ কিন্তু অন্যরা কোনো ভাতা বা সরকারি সহায়তা পান না৷
চলতি বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা বাবদ সর্বমোট বরাদ্দ করা হয়েছে ৫৫৩ কোটি ১৮ লাখ ২০ হাজার টাকা৷ সারাদেশে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে সম্মানি ভাতার জন্য এই বরাদ্দ৷ তবে এই বরাদ্দপত্রের চিঠিতেও বলা হয়েছে যাচাই-বাছাইয়ে কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণে ব্যর্থ হলে তাকে টাকা ফেরত দিতে হবে৷মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি তালিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ওই চিঠিতে৷ ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা, লাল মক্তিবার্তা তালিকা এবং প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরিত সনদ৷ এর বাইরে অন্য কোনো গেজেটেভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা এখনো যাচাই-বাছাই সাপেক্ষ৷
সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোশাররফ সোসেন মশু ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘যাচাই বাছাইয়ের নামে জামুকার কিছু কর্মকর্তা এখন তাদের ইচ্ছেমত তালিকা তৈরি শুরু করেছে৷ এখন সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, তাই সবাই মুক্তিযোদ্ধা হতে চাইছে৷ এ নিয়ে মামলার পর মামলা হচ্ছে৷ ১১৩ উপজেলার তালিকা নিয়ে মামলা চলছে৷ প্রতি উপজেলায় এক হাজারেরও বেশি অভিযোগ পরেছে৷ অথচ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধরা তালিকার বাইরে থাকছে৷''
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি ঐতিহাসিক ঘটনা: ২০১০ সালের ২৫ মার্চ যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়৷ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের দণ্ড কার্যকরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ শোধ করেছে, মোচন করেছে ইতিহাসের কলঙ্ক৷ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ এখন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ৷ আর ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আনতর্জাতিক মাতৃভাষা৷
কিন্তু স্বাধীনতা যাঁরা এনেছেন, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা এখনো অবহেলিত৷ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার পরিবর্তে এখন যেন ‘জাল মুক্তিযোদ্ধাদের' দাপট৷ সরকার মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং পোষ্যদের চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা রেখেছে৷ কিন্তু সেই কোটা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা কতটা পাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ ১১ নম্বর সেক্টরের প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা মো. নূরুল হুদার কন্যা ফৌজিয়া সুলতানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের অনেকেই সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিতে পারছেন না৷ আবার অনেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান না হয়েও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট ব্যবহার করে সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে৷ অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান তো লেখাপড়াই করতে পারেননি৷ তাঁরা কীভাবে চাকরির সুবিধা নেবেন?''
তিনি আরো বলেন, ‘‘বিভিন্ন সময় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা নানা কৌশলে, রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছেন৷ কিন্তু অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হননি৷ অনেকে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন৷ বীর প্রতীক কাঁকন বিবিকে সিএমএইচ-এ ভর্তি করা হয়েছে অনেক লেখা-লেখির পর৷''
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যাচাই-বাছাইয়ে অনেক ভুয়া মুক্তিযেদ্ধা পাওয়া যাচ্ছে৷ কিন্তু মামলার পর মামলা হওয়ায় আমরা যাচাই-বাছাই শেষ করতে পরছি না৷ ১৬৬টা মামলা চলছে৷ সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও সম্মন পেতে অনেকেই এখন মুক্তিযোদ্ধা হতে চায়৷ আমরা তাদের বাদ দিচ্ছি৷ তালিকা চূড়ান্ত হলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা থাকবে না৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘সরকার মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সন্তান বা পোষ্যদের আরো সুযোগ-সুবিধা বাড়াবে৷ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার পুরো দায়িত্ব নেবে সরকার৷''
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷