'মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মর্যাদা নেই’
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, আত্মত্যাগ, স্বাধীনতা, মুক্তি এবং একটি সার্বভৌম জাতির জন্মের বছর ১৯৭১৷ তাই একাত্তরের প্রতিটি দিনই ছিল ঘটনাবহুল৷ ডয়চে ভেলের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তারই কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরলেন বীর সাহসী নারী ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা রহমান৷ এক আহত মুক্তিযোদ্ধার করুণ বিদায় এখনও নাড়া দেয় সিতারাকে৷
তিনি জানান, ‘‘ছেলেটার নাম আহসান উল্লাহ৷ বাড়ি নরসিংদী৷ তার কথা মনে পড়লে আমি এখনও খুব অপরাধী বোধ করি এবং সম্ভবত যতোদিন বেঁচে থাকবো আমার এ বোধ একইভাবে আমাকে নাড়া দেবে৷ সে যুদ্ধ করতে গিয়ে আহত হয়ে আসল৷ হাতে-পায়ে ক্ষত এবং কিছু কাটা কাটা৷ তাকে আমাদের হাসপাতালে রাখা হলো৷ কিন্তু রাত বারোটার দিকে আমাকে একজন এসে বলল, ছেলেটির খিঁচুনি হচ্ছে৷ শুনে আশ্চর্য হলাম৷ ডা. জাফর ভাইও ছিলেন৷ আমরা গিয়ে দেখলাম৷ কিন্তু দেখা গেল, ছেলেটার ধনুষ্টংকার হয়েছে৷ ফলে তাকে তো সেখানে রাখা মুশকিল৷ আমাদের ওখানে রেড ক্রসের একটা অ্যাম্বুলেন্সের মতো গাড়ি ছিল৷ পরের দিন সকালে তাকে ঐ গাড়িতে করে আগরতলা হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম৷ সেখানে ছেলেটা মারা যায়৷ কতোদিন বেঁচে ছিল কিংবা কবে মারা যায় সেটাও জানতে পারিনি৷ আমাদের তো যোগাযোগের তেমন সুযোগ ছিল না৷ বেশ কিছুদিন পর ডা. রায় চৌধুরী আসলেন৷ তখন উনাকে জিজ্ঞেস করলাম ছেলেটার কথা৷ তিনি জানালেন যে, দুঃখিত, ছেলেটা মারা গেছে৷ তাঁর এই উত্তর শুনে আমি একদম থ হয়ে গেলাম৷ আর কোন কথাই আমি জিজ্ঞেস করতে পারিনি৷''
আরেকদিন ভারতীয় সেনা সদস্যদের বহনকারী দু'টি গাড়ি পাশের খাদে পড়ে গেলে, রাতভর জেগে তাদের উদ্ধার ও চিকিৎসা কাজে কীভাবে তৎপর ছিলেন সেই ঘটনা জানালেন ক্যাপ্টেন সিতারা, তাঁর ভাষায়, ‘‘অক্টোবরের শেষের দিকে৷ হাসপাতালের সাথে তৈরি একটি বাঁশের ঘর ছিল৷ সেখানে আমাদের খাওয়া-দাওয়া, বৈঠক করা সবই হতো৷ সেখানে বসে রাতে আমি এবং ডা. নাজিম কথা বলছিলাম৷ হঠাৎ করে হুড়মুড় করে বিকট আওয়াজ হতে লাগল৷ এরপরেই শুনতে পেলাম বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার আসছে৷ আমরা তখন রেড ক্রসের অ্যাম্বুলেন্সটা নিয়ে ঘটনাস্থলে গেলাম৷ গিয়ে দেখি একটি সেনা বহর যাচ্ছিল৷ কিন্তু সেনা ভর্তি টাটা কোম্পানির দু'টি ট্রাক পাশের খাদে পড়ে গেছে৷ খাদটি প্রায় ৫০-৬০ ফুট গভীর৷ আমরা তো বুঝতে পারছি না কী করা যায়৷ এদিকে আমাদেরকে দেখে তারাও খুব আশ্চর্য হয়ে গেছে যে, এতো রাতে এখানে মেয়ে কোথা থেকে আসল৷ তখন নাজিম ভাই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বললেন যে, ‘ইয়ে মেরে কমান্ডিং অফিসার হ্যায়৷ ক্যাপ্টেন সিতারা৷' তখন তারা আমাকে স্যালুট করা শুরু করল৷ এরপর আমি গাড়িতে করে আহত কয়েকজনকে নিয়ে হাসপাতালে আসি৷ সারা রাতই চলতে থাকল উদ্ধার কাজ এবং ঘটনাস্থল থেকে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে আসা৷ আমরা রাত জেগে সবার চিকিৎসা করতে থাকলাম৷ আমার মনে আছে, ট্রাকের চালকের উপরে গাড়ির সম্পূর্ণ ভার পড়েছিল৷ তাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি৷ পরদিন সকালে সেনা বাহিনীর গাড়ি এসে আহতদের আমাদের হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায়৷ আমি এখনও ভাবলে খুব শিহরিত হই যে, সেদিন কীভাবে আমি সাহস করে এসবকিছু করতে পেরেছিলাম৷''
বহু ত্যাগ তিতিক্ষা ও প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতি ও অর্জন সম্পর্কে বীর প্রতীক সিতারা রহমান বলেন, ‘‘আমি খুব অপমানিত বোধ করি৷ কারণ বাংলাদেশে কিছু হয়নি৷ কিছু রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি হয়েছে৷ কিন্তু নৈতিকতা বলতে কিছু নেই৷ এখনও দলাদলি চলছে৷ কে কার ক্ষতি করবে, কে কাকে টেনে নিচে নামাবে - এ রকম প্রতিযোগিতা চলতেই আছে৷ সর্বত্র যেন হিংসা আর বিদ্বেষ৷ তবে কিছুটা স্বস্তি খুঁজে পাই যখন দেখি বাংলাদেশের মানুষ এখন বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে এবং দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করছে৷ নিউইয়র্কে কিশোরগঞ্জ বিভাগের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি, প্রায় চার-পাঁচ শ' মতো বাংলাদেশি৷ এমনকি আমার গ্রামের বাড়ির পাশ থেকেও অ্যামেরিকায় এসেছে এমন অনেককে পেলাম৷ এসব দেখে মনে হলো আমার দেশ স্বাধীন না হলে তো এটা হতো না৷'' তবে যারা দেশের জন্য জান দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে তাদের কোন সম্মান নেই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বীরপ্রতীক সিতারা রহমান৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক