মর্যাদা রক্ষার প্রথা
১৮ মে ২০১৪ছোট্ট এক নাটকে দেখানো হয়েছে, তুর্কি মেয়ে জয়নাব বাসায় ফেরেনি এখনও৷ অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে৷ তার বাবা অস্থির হয়ে উঠেছেন৷ ছেলেকে বোনের খোঁজ করার জন্য তাগিদ দেন তিনি৷ সনাতন তুর্কি তরুণের মতোই ঝট করে উঠে পড়ে ভাই৷ বের হয় বোনের খোঁজে৷ পরিবারের মেয়েদের সুবোধ ও অনুগত হতে হবে৷ তাদের চালচলনের দিকে লক্ষ্য রাখা ভাইদেরও দায়িত্ব৷ একটু এদিক ওদিক হলে পরিবারের জন্য লজ্জা ও অমর্যাদা ব্যাপার হবে৷ এটাই হলো নিয়ম৷
শিক্ষার্থীদের প্রণোদনা জাগায়
বার্লিনের ফ্যার্ডিনান্ড ফ্রাইলিগ্রাট স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ১৪ বছর বয়সি ছাত্রছাত্রীরা মন দিয়ে দেখছিল এই নাটক৷ তাদের অনেকেই তুর্কি বা আরব বংশোদ্ভূত৷ নিজেদের পরিবারের সঙ্গে মিলে যায় এই ধরনের ঘটনা৷
বোনের ভূমিকায় রোনা বেক্টাস ও ভাই-এর ভূমিকায় ম্যার্ট আলবাইরাক অভিনয় করেছেন৷ দুজনই ২১/২২ বয়সি তরুণ৷
তারা বার্লিনের একটি প্রকল্প ‘হিরোস এগেনস্ট অপ্রেশন ইন দ্য নেম অফ অনার' মর্যাদার নামে নিপীড়নের বিরুদ্ধে উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ বার্লিনে ইতোমধ্যে ৩৫ জন হিরো তৈরি হয়েছেন৷ এর মধ্যে ২০ জন ওয়ার্কশপে সক্রিয়৷
প্রতি মাসে বেশ কয়েকবার তারা বার্লিনের বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে পরিবারের মর্যাদা, পুরুষের শক্তি, আত্মপরিচিতি, সমানাধিকার মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন৷
পারিবারিক মর্যাদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
স্কুলের শিক্ষার্থীরা এ ব্যাপারে একমত যে, পারিবারিক মর্যাদা তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ কোনো কোনো কিশোর বলে, ভাইয়ের কর্তব্য হলো বোন সম্পর্কে যেন লোকজন বাজে কথা না বলে, সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখা৷ নাটকে রোনা ও ম্যার্ট শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান করেছেন৷ জয়নাবকেই বাবার সঙ্গে টেলিফোন করে ঠিক করতে হবে, কতক্ষণ সে বাইরে থাকতে পারে৷
‘‘তোমরা চিন্তা করে দেখতে পারো, বোনকে জোর করে সাথে নিয়ে আসবে কিনা৷'' কয়েকজন মাথা নাড়ে৷ বাকিদের মধ্যে সংশয় দেখা যায়৷
ওয়ার্কশপে অবশ্য ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো উত্তর খোঁজা হয়নি৷ ছাত্রছাত্রীদের নিজেদেরই চিন্তাভাবনা করে পথ খুঁজে নিতে হবে৷ বলেন ইলমাজ আটমাজা৷ সাত বছর আগে বার্লিনে যাদের প্রচেষ্টায় এই প্রকল্প গড়ে উঠেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি৷ সে সময় অভিবাসী পরিবারে নারী নির্যাতনের ব্যাপারে খুব কমই প্রকল্প ছিল৷ সেইসব পরিবারের ছেলেদের এক অলিখিত আচরণবিধি থাকে, যাতে তারা অনেক সময় জোর করে হলেও পরিবারের মর্যাদা রক্ষা করতে প্রস্তুত৷ এই প্রকল্পের মাধ্যমে তারা নিজেদের আচরণ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে পারে৷
এই ধরনের সমস্যা সম্পর্কে জানেন ‘হিরোরা'
ম্যার্ট স্থাপত্য নিয়ে এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন৷ অভিবাসী পরিবারের ছেলে হিসাবে এই ধরনের সমস্যা সম্পর্কে জানেন৷ তাঁর ভাষায় ‘‘এই ছেলেরা কী চাপের মধ্যে থাকে তা আমি বুঝি৷''
রোনা জানান, ‘‘তারা (স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা) আমাদের গ্রহণ করে৷ কেননা আমরা তাদের মতোই দেখতে৷ কথাও বলি তাদের মতো করেই৷''
এই প্রকল্প রোনারের নিজের জীবনেও প্রভাব ফেলেছে৷ ২২ বছর বয়সি এই তরুণ মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছেন৷ ‘‘কিশোর কিশোরীদের নিয়ে কাজ করতে আমার ভাল লাগে৷ এ ক্ষেত্রে প্রচুর সহানুভূতি প্রয়োজন৷ অনেক কিছু নিয়ে প্রশ্ন জাগে৷ মনোবিদ্যার ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য৷ হিরোতে সম্পৃক্ত হওয়ার ফলে এই বিষয়ে ভর্তি হওয়া সহজ হয়েছে৷'' জানান রোনা৷
ম্যার্ট জানান, ‘‘আমরা ‘হিরোসের' জন্য প্রচুর সময় ব্যয় করি৷ তাই কোনো জায়গায় বায়োডাটা লিখতে হলে এটা উল্লেখ করি৷''
হিরো হিসাবে সার্টিফিকেট পাওয়ার আগে এক বছর ধরে তাঁদের প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে৷ অভিনয় ও আলোচনার কলাকৌশল শিখতে হয়েছে৷ প্রতি সপ্তাহে আলোচনা হয় হিরোদের৷ সেখানে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সমানাধিকার, নারীঅধিকার কিংবা সমকামী আন্দোলন ইত্যাদি নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়৷
আইডিয়াটা আসে সুইডেন থেকে
এই প্রজেক্টের আইডিয়াটা আসে সুইডেন থেকে৷ সুইডেনের রানি সিলভিয়ার ‘ওয়ার্ল্ড চাইল্ডহুড ফাউন্ডেশনের' পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা পায় বার্লিনের এই প্রকল্প৷ ইতোমধ্যে বেশ কিছু সম্মাননা পেয়েছে ‘হিরোস'৷ মিউনিখ, ডুইসবুর্গ, ও আউগুসবুর্গে গড়ে উঠেছে হিরোস-গ্রুপ৷ ‘‘প্রথম প্রথম বলা হতো, এতে সাড়া পাওয়া যাবে না৷ প্রকল্পের জন্য আগ্রহী তরুণও পাওয়া যাবে না৷ বলেন প্রকল্পের পরিচালক ইলমাজ আটমাজা৷ কিন্তু এখন উলটোটাই দেখা যাচ্ছে৷''
‘‘অনেকে শঙ্কিত হয়, এর মাধ্যমে হয়তো মা-বাবার সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করা শেখানো হয়৷'' বলেন ম্যার্ট৷
রোনা জানান, ‘‘আমি এক উদারমনা পরিবার থেকে এসেছি৷ আমি একজন ‘হিরো' বলে পরিবারের সবাই গর্বিত৷''