মূল্যস্ফীতি কমলে দ্রব্যমূল্য কমে না কেন?
৬ ডিসেম্বর ২০২২পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বরাত দিয়ে বলেছেন, নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি কমে ৮.৮৫ শতাংশ হয়েছে। অক্টোবর মাসে এই হার ছিলো ৮.৯১ শতাংশ।
এর আগে গত আগস্টে ছিল ৯.৮৬ শতাংশ। অবশ্য সেপ্টেম্বর মাসে একটু কমে তা হয়েছে ৯.১ শতাংশ। আগস্টের ওই মূল্যষ্ফীতি ছিল ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছিলো ১০.২ শতাংশ। এরপর মূল্যস্ফীতি আর কখনোই ৯ ভাগ ছাড়ায়নি। আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে তা ছাড়িয়ে যায়। বিবিএসের হিসেবে অক্টোবর নভেম্বর মাসে তা ৯ ভাগের নিচে নেমে এলো।
মূল্যস্ফীতির এই হিসাবটা এই বছরের কোনো মাসের সঙ্গে তার আগের বছরের একই মাসের তুলনা। সেই বিবেচনায় গত বছরের নভেম্বরে যে জিনিস ১০০ টাকায় কেনা যেত তা কিনতে এখন ১০৮.৮৫ টাকা লাগে। কিন্তু গত আগস্টে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা লাগত সেই পণ্য এখন কমপক্ষে এক টাকা কম লাগার কথা।
বিবিএসের হিসাব বলছে গত অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে আদা, ময়দা, সুজি, চিনি, ভোজ্যতেল, মসলা, ফল, পোশাক, স্বর্ণ ইত্যাদির দাম বেড়েছে। অন্যদিকে ব্রয়লার মুরগি, পাম তেল, সবজি, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ ইত্যাদির দাম নভেম্বরে কমেছে।
নভেম্বর মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। অক্টোবরে এই হার ছিল সাড়ে ৮.৫ শতাংশ। তবে নভেম্বরে খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি খাদ্যের চেয়ে বেশি, ৯.৯৮ শতাংশ। অক্টোবরে ছিলো ৯.৫৮ শতাংশ।
নভেম্বরে শহরের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় সাধারণ মূল্যস্ফীতি বড়েছে , ৮.৯৮ শতাংশ। যা অক্টোবরে ছিল ৮.৯২ শতাংশ। শহরাঞ্চলে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৮. ৭ শতাংশে নেমে এসেছে, যা অক্টোবরে ছিল ৮. ৯ শতাংশ।
বাস্তব চিত্র কী?
ক্রেতারা বলছেন, সরকার মূল্যস্ফীতি কমার যে হিসাব দিচ্ছে তা প্রতিফলন নয়। তারা অক্টোবর, নভেম্বরের মূল্যস্ফীতি কমার হিসাব দিচ্ছে কিন্তু তখন জিনিসপত্রের দাম সবচেয়ে চড়া ছিলো। গত এক সপ্তাহ ধরে শীতকালীন শাকসবজির দাম কিছুটা কমেছে। কিন্তু চাল, চিনি, মাংস, মাছের দাম একটুও কমেনি।
শেওড়াপাড়ার সাবিনা আহমেদ বলেন, "চিনির দাম কমাতো দূরের কথা এখনো বাজারে চিনি পাওয়া কঠিন। চালের দাম কমেনি। কমেনি মাছ, মাংসের দাম। ডিমের দাম কিছুটা কমেছে। সরকার কোথা থেকে দাম কম দেখে আমি তা জানি না। আমার মনে হয় যারা এটা করেন তারা বাজারে যান না। অফিসে বসেই জরিপ করেন।”
একই ধরনের কথা বলেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এ এস এম নাজের হোসেন। তিনি বলেন,"বিবিএস সরকারকে খুশি করার জন্য হয়তো এইরকম তথ্য দেয়। কোথা থেকে তারা তথ্য সংগ্রহ করে আমরা জানি না। কারণ সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যেই তথ্যের মিল নেই। টিসিবি, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশনের যে দামের তালিকা দেয় তাদের এক প্রতিষ্ঠানের দামের সাথে আরেক প্রতিষ্ঠানের দামের তালিকা মেলে না।”
তার কথা,"সরকার হয়তো পাইকারি বাজারে একটা দাম ঠিক করে দিয়ে বলে দাম কমেছে। কিন্তু বাস্তবে তো সেটা কেউ মানে না। এখন চালের দাম পাইকারি বাজারে কিছুটা কমলেও খুচরা বাজারে তো কমেনি। তাই বিবিএস যে হিসাব দেয় তা বাস্তবভিত্তিক নয়। তাদের হিসাবের সাথে বিআইডিএস, সিপিডি, সানেমসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান একমত নয়।
এদিকে বিশ্লেষকেরা বলেন, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মজুরি বৃদ্ধির একটা সম্পর্ক আছে। বিবিএসের হিসাবে নভেম্বরে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিলো ৬.৯৮ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি ৮.৮৫ শতাংশ। তাহলে মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে মূল্য বৃদ্ধির হার বেশি। ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা তো আগের চেয়ে কমছে। তাহলে সে তো আগের চেয়ে কম পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে। বিবিএসের মূল্যস্ফীতি কমার সঙ্গে মজুরি বৃদ্ধির হারকে মিলিয়ে দেখলেও বাস্তব অবস্থা বোঝা যায়।
হিসাবে গড়মিল
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো অর্থনীতিবিদ তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন," ২০০৫-৬ অর্থ বছরকে ভিত্তি বছর হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে এখনো মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হচ্ছে। এটা আসলে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এই সময়ের মধ্যে খাদ্যপণ্যসহ অনেক পণ্যের ধরন পরিবর্তন হয়েছে তা বিবেচনায় নেয়া হচ্ছেনা। তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ পদ্ধতি নিয়েও আমাদের প্রশ্ন আছে। খাদ্যের বাইরে যেসব বিবেচনায় নেয়া হয় তার মূল্য বিবেচনা নিয়ে অনেক বড় ত্রুটি আছে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আমাদের মজুরির কী হচ্ছে তাও কিন্তু স্পষ্ট নয়। সেটাও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে প্রকাশ পায়। কিন্তু বহুদিন ধরে, এমনকি করোনার সময়েও এটা শতকরা ছয় ভাগের কাছাকাছি আছে। এখানে যে মূল্যস্ফীতির হিসাব তা গড়পড়তা, এটা দিয়ে গরিব মানুষ কতটা চাপে আছে সেটা বোঝা যায় না।”
তার মতে,"এমনকি টিসিবির যে হিসাব তার সঙ্গেও এর মিল নাই। তাই মূল্যস্ফীতি হিসাবের সংস্কার প্রয়োজন। সেটা করা হলে বাস্তব চিত্র পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।”
তিনি বলেন,"আমাদের হাউজহোল্ড ইনকাম ও এক্সপেনডিচার জরিপও করা হয়নি অনেক দিন ধরে। ওটার ওপর নির্ভর করেই ভিত্তি বছর পরিবর্তন করা হয়। ফলে এখানে মূল্যস্ফীতির ভিত্তি বছরও পরিবর্তন করা যায় না। প্রকৃত চিত্রও পাওয়া যায় না।”
তার কথা,"আমাদের বিবেচনায় এখন মূল্যস্ফীতি বিবিএসের হিসাবের চেয়ে বেশি। এটা শতকরা ১১-১২ ভাগও হতে পারে।”