মূল্যস্ফীতির আরো চাপে সাধারণ মানুষ
৬ অক্টোবর ২০২২সাধারণ মানুষ আয়ের অধিকাংশ অর্থই খাদ্য কিনতে ব্যয় করে বলে তাদের ওপর চাপ সবচেয়ে বেশি৷
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দারিদ্র্য সীমার নীচে মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে৷ একই সঙ্গে সাধারণ মানুষ খাদ্যপণ্যের ভোগ কমিয়ে দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করবে৷ তাতে সাধারণ মানুষের বিশেষ করে নারী ও শিশুদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের ওপর চাপ বাড়বে৷
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো(বিবিএস) মূল্যস্ফীতির সর্বশেষ যে হিসাব তৈরি করেছে তাতে দেখা যায় গত ১১ বছর তিন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি শীর্ষে রয়েছে৷ আগস্ট মাসে তারা মূল্যস্ফীতির হিসাব করেছে ৯.৮৬ শতাংশ৷ অবশ্য সেপ্টেম্বর মাসে একটু কমে তা হয়েছে ৯.১ শতাংশ৷ আর খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি শতকরা ১০ ভাগের ওপর৷ আবার গ্রামে শহরের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি৷ তবে এই মূল্যস্ফীতির হার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি বিবিএস৷ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে দুই মাসের মূল্যস্ফীতির হিসাব একসঙ্গে প্রকাশ করা হবে৷
বাংলাদেশে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছিলো ১০.২ শতাংশ৷ এরপর মূল্যস্ফীতি আর কখনোই ৯ ভাগ ছাড়ায়নি৷ চলতি আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে তা ছাড়িয়ে গেল৷
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই মূল্যস্ফীতির পিছনে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্য পণ্যের দাম বাড়ার প্রভাব যেমন আছে তেমনি অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার সংকটও আছে৷ তবে যে কারণই থাকুক না কেন এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাচ্ছে৷ মানুষ ভোগ কমিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করছে৷ ফলে অপুষ্টি বাড়বে এবং আরো মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে যাবে৷
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশেন অব বাংলাদেশের(ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন," ওএমএস-এর ভোগ্যপণ্যের জন্য লাইন দেখলেই বোঝা যায় এরইমধ্যে নতুন করে একাংশ দারিদ্র্য সীমার নীচে চলে গেছে৷ মূল্যস্ফীতির কারনে নিম্ন আয়ের মানুষ এখন নিকে থাকতে চাল, ডিম, মাছ, মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে৷ ফলে অপুষ্টিও দেখা দেবে৷”
২০১৬ সালে বিবিএস-এর খানা জরিপে দেখা যায় দেশের মানুষ গড়ে তাদের আয়ের ৪৭.৭ ভাগ খাদ্যের পিছনে ব্যয় করেন৷ ওই জরিপের তথ্যই বলে দেয় যে মানুষের আয় যত কম খাদ্যের পিছনে সেই মানুষের মোট আয়ের আনুপাতিক ব্যয় তত বেশি৷ জরিপে মোট ১২টি ইনকাম গ্রুপ দেখানো হয়৷ তাতে বলা হয়, সর্বনিম্ন আয়ের পাঁচ ভাগ মানুষ খাবারের পিছনে তাদের আয়ের ৬২.৫ ভাগ ব্যয় করেন৷ আয়ের নিম্নতম নয়টি গ্রুপ তাদের আয়ের গড়ে ৫৫ ভাগের বেশি খাদ্যের পিছনে ব্যয় করে৷ আর সর্বোচ্চ আয়ের পাঁচ ভাগ মানুষ খাদ্যের পিছনে ব্যয় করে আয়ের ৩৩.৭ ভাগ৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন,"বিবিএস যে মূল্যস্ফীতির কথা বলছে বাস্তবে মূল্যস্ফীতি তার চেয়ে বেশি৷ তারা যে পদ্ধতিতে হিসেব করে তা অনেক পুরানো৷”
তার কথা,"এই মূল্যস্ফীতির হার শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের ওপর বেশি৷ আর শহর এবং গ্রাম উভয় এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর বেশি৷ এর কারণ ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে বেশি৷ আর নিম্ন আয়ের মানুষ ভোগ্যপণ্য কিনেতেই তার আয়ের অধিকাংশ অর্থ ব্যয় করে৷ সেটা এখন শতকরা ৮০-৯০ ভাগ হতে পারে৷ তাই এই পরিসিস্থিতিতে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে৷”
তিনি মনে করেন,"বিশ্ব পরিস্থিতি, ডলার সংকটসহ আরো অনেক সংকট আছে৷ তারপরও সরকারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার সুযোগ আছে৷ সেটা সরকার কেমন করছেনা৷ ফলে এই উচ্চমূল্য মন্দা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে৷ এটা মন্দার একটা সূচক৷”
ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ মনে করেন,"মূল্যস্ফীতির পেছনে বিশ্ববাজারের প্রভাব আছে সত্য তবে এখানে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনারও ত্রুটি আছে৷ কারণ বাজারে নিত্যপণ্যের দাম এখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্ধারণ হয় না৷ এখানে সিন্ডিকেট আছে, মধ্যস্বত্বভোগী আছে৷ চালের দাম স্বাভাবিক নেই৷ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো চালের ব্যবসায় নেমে যাওয়ায় খরচও বেড়েছে৷ বেড়েছে বাজার নিয়ন্ত্রণের শক্তি৷ আবার ভোজ্য তেলসহ আমদানি পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল হলেও এখানে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি৷ এখানেও বাজার প্রভাবিত করার অভিযোগ আছে৷”
তিনি মনে করেন,"সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে তবে তা সার্বিক নয়৷ দরকার সার্বিক ব্যবস্থাপনা৷” মূল্যস্ফীতির এই পরিস্থিতি দেশের নিম্ন এবং নিম্ন মধ্যবিত্তকে দারিদ্র্য অবস্থার মধ্যে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে তিনি বলেন," সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বিশেষ করে খাদ্য নিরপত্তা কর্মসূচি আরো বাড়াতে হবে৷”