পাহাড়চূড়ার আতঙ্ক
২৯ জুলাই ২০১৩কলকাতার জার্মান কনসুলেট ভবনের বাগানে এক গ্রীষ্মের সকালে ওদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল৷ সাউথ ক্যালকাটা ট্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সবাই৷ সেদিন ওঁরা খুব খুশি ছিলেন যে জার্মান কনসুলেটের মধ্যস্থতায় একটি ইন্দো-জার্মান রাসায়নিক সংস্থা ওদের পরবর্তী গঙ্গোত্রী-থ্রি অভিযানে আর্থিক সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে৷ পর্বতারোহী সংস্থাগুলোর জন্য এটা নিঃসন্দেহে সুখবর, কারণ প্রতি বছর পর্বতারোহণের সরঞ্জাম ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য জিনিসের খরচ এত বেড়ে চলেছে যে সামাল দেওয়া যায় না৷ বিশেষ করে পর্বতারোহণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি স্পোর্টস৷ পাহাড়ে চড়ার বিশেষ ধরনের পোশাক এবং জুতো থেকে শুরু করে ইস্পাতের গাঁইতি, দড়া-দড়ি, তাঁবু, এমনকি বিশেষ ধরনের খাদ্য-পানীয়, যা অতি উচ্চতায় আবশ্যিক, সব কিছুরই অতি চড়া দাম৷
ওদের নেহাতই দুর্ভাগ্য বলতে হবে যে প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সহায়তা পেয়ে, সেইসব মূল্যবান সাজ-সরঞ্জাম কিনতে পেরেও সব ওদের পাহাড়চূড়ায় ফেলে আসতে হয়েছে৷ স্বেচ্ছায় অবশ্যই নয়, বাধ্য হয়ে৷ কারণ প্রতিকূল প্রকৃতি এমন রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল যে হয় ওদের সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদ উচ্চতায় নেমে আসতে হতো, অথবা ওরা কেউ বেঁচে ফিরতেন না৷ তাও ওরা চেষ্টা করেছিলেন যদি কিছু দামী সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে আসা যায়৷ কিন্তু বাদ সাধেন ওদের সঙ্গী শেরপারা৷ পাহাড়ি প্রকৃতির মতিগতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ শেরপারা ওদেরকে সাফ বুঝিয়ে দেন, বাঁচতে হলে কোনও কিছুর জন্যে পিছিয়ে পড়া যাবে না৷
বস্তুত ওই শেরপাদের জন্যই সাউথ ক্যালকাটা ট্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের চার অভিযাত্রী এবারের গঙ্গোত্রী-থ্রি অভিযান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছেন৷ শৃঙ্গ জয়ের নেশায় এবং প্রবল সাহস ও আত্মবিশ্বাসে ভর করে ওরা চূড়ান্ত লক্ষ্যের খুব কাছে পৌঁছে যান৷ কিন্তু হঠাৎ আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়, প্রবল তুষারপাত শুরু হয় এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করতে না পেরে ওঁরা একটু পিছিয়ে এসে একজায়গায় তাঁবু গাড়েন৷ রাতটা সেখানেই কাটানোর সিদ্ধান্ত হয়, যেটা ওঁদের পরিকল্পনায় ছিল না৷ এতে সবথেকে বড় যে অসুবিধা হয়, ওই সাড়ে ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় অক্সিজেন এত অল্প থাকে, যে বেশি সময় সেখানে কাটানো মানে শরীরে কম অক্সিজেন যাওয়া, ফলে দ্রুত অবসন্ন হয়ে পড়া৷
তাও ওঁরা শেষ চেষ্টা করেছিলেন৷ কিন্তু হাঁটু অবধি ডুবে গিয়েছে বরফে, সেই অবস্থায় এক ঘন্টার রাস্তা পেরোতে যেখানে চার ঘণ্টা লাগছে, সেখানে পিছিয়ে আসা ছাড়া উপায় ছিল না৷ অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েও বাতিল করতে হল, কারণ এত বরফ পড়ছিল যে ওঁরা স্রেফ ডুবে যেতেন সেই তুষার সমুদ্রে৷ সারা রাত ধরে বরফ পড়ে তাঁবুর উপরে যে দু-আড়াই ফুট বরফ জমে গিয়েছে, সেটাও ওঁরা বুঝতে পারতেন না, যদি না রাতভোরে ওঁদের শেরপারা চিৎকার করে সবাইকে সতর্ক করে দিতেন৷ শেরপাদের উপরোধেই ওঁরা শেষ পর্যন্ত অভিযান বাতিল করে বেস ক্যাম্পে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন৷ আর ফেরার সময়ই দেখতে পান, রাস্তাঘাট সব বরফে ঢেকে গিয়েছে৷ কিছু চেনা যাচ্ছে না, বোঝা যাচ্ছে না৷
কোনওমতে বেঁচে ফিরেছেন, তাও ওঁদের আফসোস, পর্বতারোহণের দেড় লক্ষ টাকা দামের সরঞ্জাম ফেলে আসতে হল৷ নিয়ে আসতেই চেয়েছিলেন ওঁরা, কিন্তু একটা পর্যায়ে, ওই ভয়াল প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়ে ওঁদের সামনে একটাই সুযোগ ছিল – নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর৷ ওঁরা সেটা করতেই বাধ্য হয়েছেন৷ গত বুধবার কলকাতার জার্মান কনসুলেটে এক নৈশ অনুষ্ঠানে স্লাইড শো এবং নিজেদের শিহরণ জাগানো অভিযানের গল্প সবার সঙ্গে ভাগ করে নিলেন ওঁরা৷ যদিও সফল হয়ে ফিরতে পারেননি, গঙ্গোত্রী-থ্রি শৃঙ্গ এযাত্রায় ওঁদের অধরা থেকে গিয়েছে, তবু ওঁদেরই জন্য এই আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করার মধ্যে জার্মান কনসুলেটের স্পোর্টিং মনোভাবের পরিচয় ওঁরা নিশ্চিত পেলেন৷ এই আশ্বাসও হয়তো পেলেন যে, ওঁদের অভিযান যেমন থেমে থাকবে না, সাহায্যের হাতও নিশ্চয়ই আবার এগিয়ে আসবে ওঁদের দিকে৷