মেদিনীপুরে কারখানা সৌরভের, ঘোষণা কেন মাদ্রিদে?
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩বিনিয়োগ আনতে স্পেন সফরে গিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার ডাকে লন্ডন থেকে মাদ্রিদে আসেন ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। গত শুক্রবার স্পেনে আয়োজিত শিল্প সম্মেলনে অংশ নেন তিনি।
এই মঞ্চ থেকে সৌরভ ঘোষণা করেন, পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতে তারা একটি কারখানা গড়তে চলেছেন। সৌরভের কথায়, ''আমরা ২০০৭ সালে একটা ইস্পাত কারখানা চালু করেছিলাম। আগামী ছয় মাসের মধ্যে একটি নতুন কারখানা চালু হবে মেদিনীপুরে।''
সৌরভ জানিয়েছেন, এক বন্ধুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে তিনি ইস্পাত শিল্পে বিনিয়োগ করেছেন। এর আগে দুটি কারখানা করেছেন পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল ও বিহারের পাটনায়।
তারকার ঘোষণায় চমক
এবার শালবনিতে জিন্দল গোষ্ঠীর ফিরিয়ে দেয়া জমিতে হবে সৌরভের নতুন কারখানা। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যাবতীয় ছাড়পত্র দেয়ার জন্য তিনি মাদ্রিদের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী ও তার আমলাদের ধন্যবাদ জানান।
মুখ্যমন্ত্রীর মাদ্রিদ সফরে সৌরভের যোগদান ফুটবল বৈঠকের সূত্রেই বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু শিল্প সম্মেলনের মঞ্চে ক্রিকেট তারকার ঘোষণা এককথায় 'চমকপ্রদ'। সৌরভ দাবি করেছেন, শালবনির কারখানার জন্য আড়াই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হচ্ছে। সেখানে ছয় হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
সুদূর মাদ্রিদের এই ঘোষণায় শোরগোল পড়ে গিয়েছে বাংলায়। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ''কলকাতা, দিল্লি, মুম্বইয়ে এই ঘোষণা কেন করলেন না সৌরভ? রাজ্যে শিল্পের ভাবমূর্তি উদ্ধার করতে তাকে কাজে লাগাতে চাইছে রাজ্য সরকার।''
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের প্রসঙ্গ টেনেছেন। তাদের কাছ থেকে পাওয়া সৌরভের জমি নিয়ে আইনি জটিলতার কথা বলেছেন।
রাজ্যের অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বিজেপির সমালোচনা উড়িয়ে বলেছেন, ''সৌরভ কোথায় কোন ঘোষণা করবেন, সেটা বিজেপির কাছ থেকে শিখতে হবে? একজন ক্রিকেট তারকা শিল্পে লগ্নি করবেন, এটাই বড় কথা।''
প্রশ্নের মুখে 'আইকন'
বণিকসভার সূত্রে খবর, সৌরভ অনেক বছর ধরে একটি ইস্পাত সংস্থার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। সংস্থার সূত্র অনুযায়ী, এখানে সৌরভের অংশীদারিত্ব রয়েছে। এদেরই কারখানা তৈরি হবে শালবনিতে। যদিও এ কথা সৌরভ নিজে স্পষ্ট করে বলেননি বা কোনো বিবৃতি জারি করা হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা থাকায় প্রশ্ন উঠছে, আগে নির্মিত দুটি কারখানার কথা সৌরভ কেন অতীতে বলেননি? শালবনির কারখানা নির্মাণের প্রস্তুতি সত্ত্বেও কেন সে কথা এতো দিন প্রকাশ্যে আনেননি? ২০০৭ সালে প্রথম লগ্নি করে থাকলেও কেন দেড় দশক পর মাদ্রিদে শিল্পপতি সৌরভ 'আত্মপ্রকাশ' করলেন?
মাদ্রিদে দুই দিনের সফর সেরে সৌরভ সপরিবার লন্ডনে ফিরে গিয়েছেন। এ মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি কলকাতায় ফেরার পর এ সব প্রশ্নের জবাব মিলতে পারে।
অর্থনীতিবিদ ও আইআইএম-এর অধ্যাপক অনুপ সিনহা বলেন, ''সৌরভ কারখানায় বিনিয়োগ করতেই পারেন। কিন্তু তার ঘোষণা এত দূরে গিয়ে কেন করতে হলো, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। লগ্নিতে স্পেনের যৌথ সহযোগিতা না থাকলে স্পেনে গিয়ে ঘোষণা করার মানে কী?'' রাজ্যের সাবেক শ্রমমন্ত্রী ও বাম শ্রমিক নেতা অনাদিকুমার সাহু বলেন, ''২০০৭ সালে সৌরভ ক্রিকেট মাঠে দৌড়চ্ছেন। তখন তিনি কীভাবে ব্যবসায় নামলেন?''
মুখ্যমন্ত্রীর সফর
মুখ্যমন্ত্রী পাঁচ বছর পর বিদেশ সফরে গেলেন। তা নিয়েও কটাক্ষ করছে বিরোধীরা। সাহু বলেন, ''মুখ্যমন্ত্রী গত ১২ বছরে অনেক বাণিজ্য সম্মেলন করেছেন, কিন্তু কোনো বড় উল্লেখযোগ্য শিল্প রাজ্যে আসেনি। সিঙ্গুর থেকে নয়াচর, ওর বাধাতেই শিল্প হয়নি।''
বাম আমলে রাজ্যে বহু কলকারখানা বন্ধ হয়েছিল। সেই ধারা যে বিশেষ পাল্টায়নি, তা শ্রম দপ্তরের হিসেবই বলছে। গত নভেম্বরে শ্রমমন্ত্রী বিধানসভায় জানান, রাজ্যে বন্ধ কারখানার সংখ্যা ১৭৭। বাম শাসনে এই সংখ্যা ছিল ১০০-র কম।
এবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পেনে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পবান্ধব পরিস্থিতির কথা ঘোষণা করেন। যদিও বিরোধীদের মত অন্য। সাহু বলেন, ''তৃণমূলের আমলে কোনো শিল্পের অনুকূল পরিবেশ রাজ্যে নেই। তোলাবাজি আর কাটমানি শিল্পের পরিবেশ নষ্ট করেছে।''
চট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং, বিভিন্ন শিল্প সংস্থার বন্ধ কারখানা ছড়িয়ে রয়েছে জেলায় জেলায়। হাজার হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন আগামী নভেম্বরে ফের আয়োজিত হবে। তার আগেই শোনা গেল সৌরভের 'চমকপ্রদ' ঘোষণা। তাতে কি শিল্পায়নের খরা কাটবে?