1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মোদী, মমতা, ভুয়া ভ্যাকসিন এবং আমজনতা

৩০ জুন ২০২১

ভুয়া ভ্যাকসিনকাণ্ডে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তাতে ক'জনের মনে স্বস্তি ফিরেছে বলা মুশকিল৷ তবে ভারত সরকার যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মৌখিক ক্ষোভেই ভরসা রাখতে চায় না তা খুব স্পষ্ট৷

https://p.dw.com/p/3vpUe
Bangladesch Mamta Bannerjee in Dhaka
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman

এখন ভুয়া ভ্যাকসিন নিয়েও কেন্দ্র বনাম রাজ্য ‘রাজনীতি' শুরু না হলেই আমজনতার কল্যাণ৷

ভুয়া ভ্যাকসিন নিয়েও দায় এড়ানো এবং ‘খবরদারির' রাজনীতি নিঃসন্দেহে খুবই অনাকাঙ্খিত, তবে ভারতে তা-ও সম্ভব৷ সেখানে প্রায় সব কিছুই চলছে নির্দিষ্ট প্যাটার্নে৷ একেবারে ছকেবাঁধা পথে৷ এমবাপের পেনাল্টি মিস হতে পারে, কিন্তু মোদী আর মমতা সম্পর্কে কিছু পূর্বানুমান মিস হবার নয়৷

নির্বাচন এলে মোদী সরকার, বিজেপি এবং তাদের মিত্ররা প্রবল পাকিস্তান-বিরোধী  হবে, ‘স্বধর্মপ্রেম' প্রকাশে অতি তৎপর হবে, ভিন্নধর্মাবলম্বীদের অস্বস্তিতে ফেলে, তাদের নিরাপত্তাহীনতায় ত্রস্ত করে দেশপ্রেম জাহির করবে- এ তো জানা কথা৷ মোদীর সমালোচনা করলেই গেরুয়া শিবির থেকে ‘দেশবিরোধী, দেশবিরোধী' শোর উঠবে- তা-ও অনিবার্য৷ আরেকটি অনিবার্য বিষয় হলো, বিজেপির ‘অতীতের বন্ধু' মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সুযোগ পেলেই বিব্রত করা৷ ১৯৯৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০০১-এর মার্চ পর্যন্ত বাজপেয়ীর বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের রেলমন্ত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ কিন্তু পরবর্তীতে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর সঙ্গে এনডিএ বা বিজেপির সুসম্পর্কটা মোটা দাগে আর থাকেনি৷ মোদীর বিজেপি এখন প্রবল মমতা-বিরোধী৷ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারণার সময় বিরোধ চরমে উঠেছিল৷ অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের সীমা ছাড়িয়েছিল দু' পক্ষের বক্তব্য৷ নির্বাচনে মোদীর বিজেপি চূড়ান্ত লক্ষ্যের কাছাকাছিও যেতে পারেনি৷ নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসই আবার রাজ্যের ক্ষমতায়৷ সেই থেকে নতুন করে শুরু নানা ইস্যুতে কেন্দ্র-রাজ্য চাপানউতোর৷ আজ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক তো কাল মুখ্যমন্ত্রী আর রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতির ঝড়৷দিনে নারদ মামলায় ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, শোভন চট্টোপাধ্যায় ও মদন মিত্রের গ্রেপ্তারের ঘটনায় মমতা সিবিআই অফিসে অবস্থান নেন তো মাঝরাতে জেলে যেতে হয় অভিযুক্ত নেতাদের৷

এর মাঝেই চলছিল করোনা রোখার লড়াই৷

চলছিল ভ্যাকসিন কার্যক্রম৷

কিন্তু গত ২৩ জুন অভিনেত্রী এবং তৃণমূল সাংসদ মিমি চক্রবর্তীর ভুয়া ভ্যাকসিন নেয়ার খবরে সেই কার্যক্রম হয়ে পড়ে প্রশ্নবিদ্ধ৷ মিমি জানান, দেবাঞ্জন দেব নামের এক ব্যক্তি রীতিমতো শিবির খুলে ভুয়া ভ্যাকসিন দিয়েছেন৷ না বুঝে, দেবাঞ্জনকে বিশ্বাস করে মিমি নিজেও নিয়েছেন সেই ভ্যাকসিন৷ সংবাদমাধ্যমকে মিমি বলেন, ‘‘আমার কাছে দেবাঞ্জন দেব আসেন। নিজেকে আইএএস অফিসার এবং কলকাতা পুরসভার যুগ্ম-কমিশনার হিসেবে ভুয়ো পরিচয় দেন। প্রচার করেন, কলকাতা পুরসভা এই শিবিরের আয়োজক।'' কিন্ত ভ্যাকসিন নিয়ে কোনো রিপোর্ট না পাওয়ায় সন্দেহ জাগে রাজনীতিতে এখনো মোটামুটি নতুন মুখ মিমির মনে৷ ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে প্রতারক দেবাঞ্জনের একাধিক জায়গায় শিবির খুলে শত শত মানুষকে ভুয়া ভ্যাকসিন দেয়ার তথ্য৷

এমন ভয়ঙ্কর এক প্রতারণার খবর প্রকাশের জন্য মিমি চক্রবর্তীকে ধন্যবাদ দিতেই হয়, কারণ, ‘বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ' ভারতে ক্ষমতাধরদের খোলামনে প্রশ্ন করার সুযোগ ক্রমশ কমছে৷ ফলে অনেক কিছুই থেকে যাচ্ছে আড়ালে, জবাবদিহিতার আওতায় আসছেন না কেউ৷

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘মন কি বাত’ বলেন বটে, তবে তাকে দেশের বড় বড় দুর্নীতি, সরকারের বড় বড় ব্যর্থতার বিষয়ে সরাসরি প্রশ্ন করা যায় না৷প্রশ্ন তুললে প্রশ্ন উত্থাপনকারীই হয়ে যান দেশদ্রোহী৷

পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন হলেও ফলাফল একই৷ সেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোাধ্যায়কে কেউ কেউ খুব প্রয়োজনীয় বা জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন কখনোসখনো করতে পেরেছেন ঠিকই, তবে সেসব প্রশ্নের জবাব পাননি, পেয়েছেন অপমান, অপবাদ কিংবা কারাদণ্ড৷

রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে মত বিনিময়ের বিষয়টি মনে হয় ভারতের রাজনীতি থেকেই ধীরে ধীরে বিলীন হতে চলেছে৷ বিরোধীদের প্রশ্নের সদুত্তর তাই এত বিরল যে হঠাৎ দেখলে বা শুনলে বিস্মিত এবং চমৎকৃত হতে হয়৷

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দৃশ্যত ‘অরাজনৈতিক' ব্যক্তিদের মুখেও ‘অপছন্দনীয়' প্রশ্ন কখনো শুনতে চান না৷ প্রশ্ন করে নাজেহাল হওয়ার দৃষ্টান্ত আছে অসংখ্য৷

শিক্ষার্থীদের মাঝে গিয়েও এমন অননুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখেছেন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে কয়েকটি বিষয়ে জানতে চেয়ে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী এমন আচরণের শিকার হয়েছিলেন যা তাদের আজীবন মনে থাকার কথা৷

এক কলেজ ছাত্রীকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হলো৷ সারা গ্রামে শুরু হলো বিক্ষোভ৷ মুখ্যমন্ত্রীকে পেয়ে বিক্ষুব্ধ নারীরা তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন৷ কামদুনির ওই নারীদেরও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষার্থীদের মতো ‘সিপিএম ক্যাডার', ‘মাওবাদী' বলে ভর্ৎসনা করতে করতে চলে এসেছিলেন তা পশ্চিমবঙ্গের কোনো রাজনীতিসচেতন মানুষেরই ভোলার কথা নয়৷

মোদীর ভারতে কৃষকেরা ভুগে ভুগে মরছে৷ মাসের পর মাস ধরে আন্দোলন করেও সাড়া পাচ্ছেন না৷ তাদের সঙ্গে একটি বারের জন্যও দেখা করতে যাচ্ছেন না নরেন্দ্র মোদী৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কৃষকদের কাছে যান, তাদের সঙ্গে কথা বলেন৷ কিন্তু প্রশ্ন বা কথা মনমতো না হলে তাদের কী অবস্থা হতে পারে তা নিশ্চয়ই পশ্চিমবঙ্গের কৃষকেরা বুঝতে পারেন শিলাদিত্যের কারাবরণের ঘটনা মনে করে৷ শিলাদিত্যের অপরাধ- তিনি সারের দাম নিয়ে একটা প্রশ্ন করেছিলেন!

এমন বাস্তবতায় কোনো তদন্ত না করে, কাউকে কোনো প্রশ্ন না করেই ভ্যাকসিন জালিয়াতির এত বড় খবর জানতে পারা অবশ্যই সৌভাগ্যের বিষয়৷ পশ্চিমবঙ্গবাসীর আপাতত এই সৌভাগ্যটুকু হয়েছে শুধু মিমি চক্রবর্তীর কল্যাণে৷ মিমি না জানালে দেবাঞ্জন নামের তৃণমূলঘনিষ্ঠ এক প্রতারকের কীর্তিগাঁথা আড়ালেই থেকে যেতো, ভ্যাকসিন নেয়ার স্বস্তি নিয়ে দিব্যি ঘুরেফিরে অসংখ্য মানুষ হয়ত করোনায় ভুগে টুক করে চলে যেতো জীবনের ওপারে৷

সেই আশঙ্কা এখনো অবশ্য পুরোপুরি দূর হয়নি৷ জাল টিকা-কাণ্ডে রাজ্যের কাছে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট চেয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। এ নিয়ে যদি সেই কেন্দ্র-রাজ্য, বিজেপি-তৃণমূল কথার লড়াই শুরু হয়  তাহলেই করোনা ভাইরাসের পোয়াবারো৷ মৃতের সংখ্যাও তো কমানো হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে, করোনা কি তাতে দূর হয়েছে? করোনা বৈশ্বিক সমস্যা৷ এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে বিজ্ঞানের বেঁধে দেয়া নিয়মে৷ গো-মূত্রে কাজ হবে না, কথার বাগাড়ম্বরেও নয়৷

মমতা বলেছেন, ভ্যাকসিন নিয়ে যে প্রতারণা করে সে সন্ত্রাসীদের চেয়েও বড় সন্ত্রাসী৷ তার এ বক্তব্যের আগেই দেবাঞ্জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ কিন্তু একজন দেবাঞ্জনকে গ্রেপ্তার করে করোনার বিরুদ্ধে জেতা যায় না৷

এক পুলিশ কর্মকর্তা গাড়ি নিয়ে আসতে দেরি করায় তার সঙ্গে মমতা যেমন আচরণ করেছিলেন, চিত্র সাংবাদিকদের কুঁদে যেভাবে চড় মারতে গিয়েছিলেন, সেরকম আচরণ কারো সঙ্গেই কাম্য নয়৷

তবে জালিয়াতিতে জড়িতদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা এবং জালিয়াতির শিকারদের সুচিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থাপনায় টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে নিতে মুখ্যমন্ত্রীর কঠোর পদক্ষেপ খুব জরুরি৷