পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনের খবরের মাধ্যমে জেনেছি সেটার কারণ। কেন ঠিকভাবে তারা খেলেনি তার ব্যাখ্যাও দিয়েছে তারা, তবে আমার মনে হয় মেয়েদের কাজটা ভালো হয়নি। বর্তমান কোচ নাকি সিনিয়রদের খেলাচ্ছে না, এমন কিছু কথা বলেছেন মেয়েরা। আমার মনে হয়েছে যখন কেউ খেলতে যাবে ওই দলের কোচের ওপর তাদের ভরসা রাখা জরুরি।
পাকিস্তানের সঙ্গে যেমনই খেলুক পরের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফর্ম করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশে দল।
আমি মনে করি, মাঠের খেলা মাঠে থাকাই ভালো, খেলোয়াড়রা যেন অহেতুক বিতর্কে না জড়ায়। তাতে খেলা থেকে মনোযোগ সরে যেতে পারে এবং তার স্বাভাবিক পারফরম্যান্স ব্যাহত হবার সম্ভাবনাই বেশি।
ফুটবলারদের নজর থাকা উচিত নিজেদের পারফর্ম্যান্সের দিকে, সে আগে কতটা কি করেছে তার থেকেও জরুরি তারা যে টুর্নামেন্টে গিয়েছে সেটার সাফল্যের দিকে। কোচের নির্দেশনা খেলোয়াড়দের মেনে নেয়া উচিত। হয়তো সেই জায়গাটায় তারা কাজ করতে পেরেছে এবং শেষ পর্যন্ত সাফল্যও পেয়েছে বাংলাদেশ। এজন্য পুরো দলটারই প্রশংসা করতে হবে। তবে ভবিষ্যতে ক্রীড়া শিক্ষার দিকে এদের নজর দিতে হবে। জাতীয় দলের যারা ক্যাম্পে থাকেন তাদের দীর্ঘদিনের বোঝাপড়া থাকলেও কোনো এক জায়গায় অমিল থাকতেই পারে। কিন্তু কোন কথা কখন বলতে হবে, কোথায় থামতে হবে এটা জানা মেয়েদের জরুরি।
এমনিতেই আমাদের দেশে খেলাধুলার অবস্থা খুব একটা ভালো না। সেখানে নারী ফুটবল বরাবরই আশা জাগিয়েছে। এ কারণে বিস্তার ঘটেছে এটার। তাই মেয়েদের সংবেদনশীল ও সহনশীল হতে হবে।
বর্তমান কোচ পিটার বাটলার নারী ফুটবল নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করেছেন। বাংলাদেশের পুরো ফুটবলকে পর্যবেক্ষণ করেছেন বলে এমন চমৎকার বলতে পেরেছেন তিনি। আসলে আমাদের মেয়েদের সম্ভাবনা আছে, কিন্তু এখানে আদৌ কি কোনো পরিকল্পনা আছে? বাফুফে ভবনে গাদাগাদি করে থাকে মেয়েরা। নারী লিগ হয় একপেশে। নামমাত্র অ্যাকাডেমি আছে বাফুফেতে, তাতে কোনো সঠিক পরিকল্পনা নেই, পিটার বাটলার তিনি এর সবই জানেন। আমার বিশ্বাস তিনি বাংলাদেশ ফুটবলটাকে গভীরভাবে বুঝতে পেরেছেন, এই সমাধানের রাস্তাটাও হয়তো তার জানা আছে, এ জাতীয় কোচেকে কাজের স্বাধীনতা দেওয়া উচিত বলে মনে করছি।
ইতিমধ্যে আমরা সবাই জেনে গেছি সাবিনা, মারিয়াদের ৩ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে! আর আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে এমনটা কিন্তু এই প্রথমবার ঘটলো তা নয়, আগেও এমনটা হয়েছে৷ খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকের টাকা আগেও বকেয়া থেকেছে। এই খেলোয়াড়রা কত টাকাই বা পায়! সেটাও বকেয়া রাখতে হবে!? এত অল্প টাকা দেওয়া হয় ওদের, অথচ খেলোয়াড়দের জীবনে প্রাইম সময়টুকুই দিয়ে দিচ্ছে ওরা। কিন্তু সামান্য কটি টাকা শোধ করছেন না খেলোয়াড়দের দায়িত্বে থাকা কর্তাবৃন্দ ? এই মেয়েরা যেখান থেকে উঠে এসেছে ওদের প্রতি এবং ওদের পরিবারের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, হয়তবা ওদের অনেকের কাছেই এই সামান্য অর্থটুকুও অনেক কিছু।
এই সংগঠকেরা ৩ মাসের টাকা বকেয়া রেখে খেলোয়াড়দের একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করতে নিয়ে গিয়েছে! সংগঠক হয়ে যদি খেলোয়াড়দের বেতন দিতে ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা না করতে পারে, তাহলে সে কি ব্যর্থ নয়?
খেলোয়াড়দের জন্য নিউট্রিশনিস্ট রাখা জরুরি। নিউট্রিশনযুক্ত খাবার পরিবেশন করা হয় কিনা সেটাও খেয়াল রাখা উচিত, যাতে করে লং টার্ম ক্যাম্পে তাদের খাবারের প্রতি একঘেয়েমি ও অরুচি না আসে। আমি আবারও বলছি, আমাদের এই মেয়েদের মাঝে অনেক সম্ভাবনা আছে, গত বছর অলিম্পিকের বাছাইয়ে খেলার সুযোগ পেয়েও নষ্ট করেছে বাফুফে দায়িত্বরত কর্তাবৃন্দ এটা মোটেও ঠিক হয়নি বলে মনে করছি। অলিম্পিক বাছাইয়ে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ দুটি দল বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল ছিল। ফুটবলপ্রেমীদের মনে প্রশ্ন তো জাগেই হেরে যাওয়ার ভয় এবং নেতিবাচক সমালোচনার মুখে পড়তে হবে বলেই কি এত বড় সুযোগ পেয়েও দলটিকে খেলতে পাঠায়নি বাফুফে? ব্যাপারটা মোটেও ঠিক হয়নি বলে মনে করছি। আমরা এশিয়ান লেভেলে না খেললে বিশ্বমানে কবে খেলবো?
বাংলাদেশ নারী ফুটবল অল্প দিনের না, ২১ বছর হয়ে গেছে মেয়েদের ফুটবল। ঘরোয়া ফুটবল শুরু হয়েছে ২০০৪ সাল থেকে। এর ২০ বছর পরও এশিয় পর্যায়ে খেলতে পারবে না বা সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাবে না এটা কি সঠিক?
আরেকটা কথা বলতে চাই, মেয়েদের ফুটবল এলেই বাফুফের টাকা পয়সার ঘাটতি দেখা দেয়।! যদি কোনো ঘাটতি থেকে থাকে, তবে সেটা পূরণের দায়িত্ব কি দায়িত্বরত কর্তাদের নয়? ফিফা উইন্ডোর সকল খেলাসহ আন্তর্জাতিক সকল প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট এবং অলিম্পিক বাছাইয়ে বড় আসরে পাঠাতে না পারার পুনরাবৃত্তি যেন আর না হয়।
আমি মনে করি, আমাদের মেয়েরা একদিন বিশ্বকাপে খেলবে। কিন্তু সঠিক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় নারীদের ফুটবল একাডেমি হোক। একাডেমি কাপ কিংবা একাডেমি লীগ হলে, একাডেমির খেলোয়াড় সহ একাডেমীর কোচেরাও লোকাল গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব মঞ্চে নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ পাবেন। ক্লাবগুলোতে নারীদের একটি করে বয়স ভিত্তিক দল ও একটি করে সিনিয়র দল থাকা উচিত বলে মনে করছি। এই একাডেমী এবং ক্লাব পদ্ধতিকে সচল রাখলে, নারী ফুটবলের উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ হবে আমার বিশ্বাস। সেখান থেকে ঋতুপর্ণা চাকমা, শামসুন্নাহার জুনিয়রের মতো বা ওদের থেকেও ভালো মানের ফুটবলার হয়তো বের হয়ে আসতে পারে।
২০০৩ সালে যখন দেশে নারী ফুটবল শুরু হলো তখন থেকে আমার ফুটবল যাত্রা শুরু। তখন পশ্চিমবঙ্গের একটা দল বাংলাদেশে এসেছিল। তারা প্রথমে যশোরে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ, দ্বিতীয়টি ঢাকার মিরপুরে হয়েছিল, সেখানে আমি বাংলাদেশ এ দলের খেলোয়াড় হিসেবে খেলেছিলাম। তৎকালীন আউটার স্টেডিয়াম যাকে এখন আমারা হোম অফ ক্রিকেট বলে জানি ওখানে ম্যাচটি হয়েছিল। ২০০৩ তখন বিজেএমসিতে ও জাতীয় দলে নিয়মিত হ্যান্ডবল খেলতাম, ওই সময় ডানা আপা (তৎকালীন মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক কামরুন নাহার) বললেন, কারা কারা ফুটবল খেলতে পারো? যারা কিনা ফুটবলটা একটু জানতো তাদের নিয়ে টিম গঠন করা হলো। তখন ফিফার নির্দেশনা ছিল বাংলাদেশে নারীরা ফুটবল না খেললে তাদের জন্য আসা বাফুফের বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যাবে। যে কোনো কিছু শুরুটা অনেক কষ্টের হয়, এ দেশে নারী ফুটবলের শুরুটা অনেকটা কষ্টের ছিল কোনোভাবেই সেটা মসৃণ ছিল না। কমলাপুর স্টেডিয়ামে ছিলাম, বাইরে একদল লোক ফুটবলবিরোধিতা করে খেলা করাতে দেবে না বলে মিছিল করছিল, ইট-পাটকেল ছুড় ছিল, সেটা উপেক্ষা করে বাফুফের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং সংস্থার সম্পাদিকা কামরুন্নাহার ডানা আপার সাহসী নেতৃত্বে পুরো টুর্নামেন্টটি নির্বিঘ্নে শেষ হলো। তখন বাফুফে ও বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা আন্তঃজেলা ফুটবলের আয়োজন করছিল। সেই সময়ে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রম করা হলো। সেখান থেকে জয়া চাকমা, নুবাই, সুইনু প্রু মারমা, মাইনু প্রু মারমাদের মতো আদিবাসী ফুটবলার উঠে এলো।
আমি ২০০৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্তু দেশের প্রতিযোগিতাগুলিতে অংশগ্রহণ করেছি, ২০০৬ থেকে ২০০৮ জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেছি। ২০০৯ সালে সাউথ এশিয়ান গেমসের ক্যাম্পে ৩৮ জনকে ডাকলেও আমাকে ডাকেনি বাফুফে। অথচ তখনো আমি জাতীয় দলের অধিনায়ক! এবং আমি পুরোপুরি ফিট। পারফর্ম্যান্সের কারণে ঝরে পড়ার দায় ফুটবলারের। কিন্তু কেউ যদি জোর করে বাদ দেয়, সেটা এক রকম অবিচার। আমার সঙ্গে যা ঘটেছে, তাতে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। আসলে এমনটা এখনো হচ্ছে। অনেক ফুটবলারকে একটু চোটে পড়লেই বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আবার মুখ চিনে চিনে ক্যাম্প থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়। এখানে বাফুফের স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতা থাকা উচিত। সঠিক একটা গাইডলাইন থাকা উচিত। যেন অন্যায়ভাবে খেলোয়াড়রা নিগ্রহের শিকার না হন। যদি ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট কোথাও একটা গোপন অভিযোগ বাক্স থাকতো বা অনলাইনে অভিযোগের প্ল্যাটফর্ম থাকতো, তাহলে খেলোয়াড়রা, কোচ ও অন্য অন্যরা তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারতো। আমি চাই, যারা এ জাতীয় কাজ করেছে বা করছে, তাদের কারণে ফুটবলাররা যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেটার একটা সমাধান হোক।
অনেকে ফুটবল ছেড়ে দিলেও তাদের কোনো কর্মসংস্থান থাকে না। চোটে বাদ পড়ে বাড়িতে চলে যায়। আজ শুরুর দিকে যারা খেলেছে, তাদের কথা তো বাদই দিলাম, এমনকি আঁখি খাতুন, সিরাত জাহান স্বপ্নার খোঁজ কেউ রাখে না। অথচ গত সাফে সে চোটে না পড়লে টুর্নামেন্টের সেরা ফুটবলার হতে পারতো।
আরেকটা কথা বলতে চাই। আমাদের নারী ফুটবলারদের স্বাস্থ্য বিমা থাকা উচিত। কিছু হলে সেটার দায়ভার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে, সে বিষয়ে খেলোয়াড়ের এবং বাফুফের সোচ্চার হতে হবে। ছেলেদের ফুটবলে একজন খেলোয়াড়কে ক্লাব ৮০ লাখ টাকা দিচ্ছে। কিন্তু মেয়েদের একটা পুরো দল গড়তে ৫০ লাখ খরচ করতে কষ্ট হয়ে যায়। অথচ দেখেন, এই মেয়েরাই একদিন বিশ্বকাপ খেলবে।
পরিশেষে বলতে চাই, শুধু চেয়ার আঁকড়ে থাকলে হবে না, নিজেদের শোধরাতে হবে, কারণ, একজন ফুটবলারের খেলোয়াড় থাকা অবস্থায় দায়িত্ব এবং ক্যারিয়ার শেষে কর্মসংস্থান পাইয়ে না দিতে পারলে ঐ খেলোয়াড়ের বাবা-মা তাকে কেন খেলতে পাঠাবেন? আমাদের এখন থেকেই ১৫-২০ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা করা উচিত। কে জানে একদিন বাংলাদেশের মেয়েরাই বিশ্ব মানচিত্রে ফুটবল দিয়ে ওড়াবে লাল সবুজের পতাকা।