1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মেয়েদের মর্যাদা তো অলীক ঘটনা

৯ এপ্রিল ২০২১

স্কুলে বাচ্চাদের রচনা লিখতে বলা হয় নারীর মর্যাদা নিয়ে৷ বিষয়টি কেতাবেই আছে৷ বাস্তবে তার বড়ই অভাব৷ এটাই ভারতে বাস্তব৷

https://p.dw.com/p/3rnEV
ছবি: dapd

যত দোষ সব মেয়েদের!

চারপাশে একটু কান পাতলেই শোনা যাবে এই আপ্তবাক্য৷ ভারতীয় দর্শন বলে আপ্তবাক্য মানে এমন মানুষের কথা, যাদের উপর বিশ্বাস রাখা যায়, ভরসা করা যায়৷ তা এরা সকলে তেমনই মানুষ৷ কেউ মুখ্যমন্ত্রী, কেউ মন্ত্রী, কেউ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংসদ৷ তাদের কথা তো মানুষ উড়িয়ে দিতে পারেন না৷ তাদের দাওয়াই, ধর্ষণ হলেও মেয়েদের দোষ, চুল কাটলে দোষ, সুন্দরী হলে দোষ, না হলেও দোষ৷ এককথায় মেয়ে হওয়াটাই দোষের৷ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের মর্যাদা তো মরীচিকার মতোই অলীক৷

বছর পাঁচেক আগের কথা৷ সে সময়ে কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রী মহেশ শর্মা জানালেন, বিমানবন্দরে নামলেই পর্যটকদের হাতে একটা তালিকা ধরিয়ে দেয়া হবে৷ সেখানে বলা থাকবে, ছোট শহরে রাতের বেলায় একা স্কার্ট পরে বা ছোটখাট পোশাক পরে কেউ যেন বের না হন৷

মানেটা কী? স্কার্ট পরলে বা ছোট পোশাক পরে একা বের হলে নারী-নিগ্রহ হবে? সরকারি পুলিশ, প্রশাসন তা হলে আছে কী করতে? মেয়েদের নিয়ে এরকম অমর্যাদাকর মন্তব্যের তো কোনো অভাব নেই৷ তারা কী পরবেন, সেটাও ছেলেরা ঠিক করে দেবে৷ কী পরবে না সেই ফতোয়াও তারা দেবে৷ একা বেরোবে, নাকি সবসময় এক বা একাধিক পুরুষ বডিগার্ড লাগবে, সেটাও পুরুষেরাই ঠিক করে দেবে৷ তাহলে সংবিধানে সকলে সমান কথাটা বলা আছে কীসের জন্য?

কখনো রাজস্থান, কখনো কর্ণাটক, কখনো রাঁচি, কখনো বা পশ্চিমবঙ্গ থেকে খবর আসে, কোনো একটি কলেজে মেয়েদের শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ পরা বাধ্যতামূলক হয়েছে৷ কেউ জিনস, স্কার্ট বা অন্য পোশাক পরতে পারবে না? এর থেকে অমর্যাদাকর সিদ্ধান্ত আর আছে? তাহলে ছাত্রদের কেন বলা হয় না, ধুতি পাঞ্জাবি বা পাজামা পাঞ্জাবি ছাড়া কেউ কলেজে আসতে পারবে না? ছেলেরা যা খুশি পোশাক পরতে পারবে, মেয়েরা নয়- এ কোন মধ্যযুগে পড়ে আছি আমরা?

কিছুদিন আগেই উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী তিরথ সিং রাওয়াত বলে বসলেন, মেয়েরা ছেঁড়া জিনস পরে হাঁটু দেখিয়ে যদি সমাজে ঘোরে, মানুষের কাছে সমস্যা সমাধানের জন্য যায়, তাহলে সমাজের কাছে, বাচ্চাদের কাছে আমরা কী বার্তা দিচ্ছি? মোয়েরা কী পোশাক পরবেন, সেটা ঠিক করার জন্য কী তাকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছে? ছেলেরা যা খুশি পরতে পারে৷ মেয়েরা নয়৷ হাঁটুর কাছে ফাটা জিনস পরলেই মুখ্যমন্ত্রীর অসুবিধা হচ্ছে৷ ছেলেরা পরলে নয়৷ ছেলেরা খালি গায়ে লুঙ্গি পরে, সেটাও ভাঁজ করে হাঁটুর অনেকখানি উপরে তুলে ঘুরতে পারে বা সংক্ষিপ্ততম পোশাক পরতে পারে, তাতে কোনো অসুবিধা নেই৷ মেয়েরা তো শুধু ঘরকন্না করবে, বাচ্চার জন্ম দেবে, রান্না-বান্না করবে, পতির সেবা করবে৷ তার বাইরে আবার কী অধিকার চাই? ফলে সমানে পুরুষরা মেয়েদের সম্পর্কে মর্যাদাহানিকর কথা বলে যান৷

সমাজবাদী পার্টির নেতা আবু আজমি ২০১৬ সালে বলেছিলেন, মেয়েরা ছোটখাট পোশাক পরে পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, সে জন্যই দেশে ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে৷ মেয়েরা ছোট পোশাক পরে বলে ধর্ষণ হয়৷

দেশের আইন বলে ধর্ষণ অপরাধ, ধর্ষণ করলে ফাঁসি পর্যন্ত হতে পারে৷ অথচ এই রাজনৈতিক নেতারা ধর্ষণের অধিকারই প্রায় পুরুষদের হাতে তুলে দিচ্ছেন৷

একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের নেতা বছর কয়েক আগে বলেছিলেন, রেপ জিনিসটাই নাকি শহুরে অপরাধ৷ এটা পশ্চিমা সংস্কৃতির জন্য হচ্ছে৷ চিরাচরিত মূল্যবোধ গ্রামে টিকে আছে বলে সেখানে কোনো রেপ হয় না৷ এরপর বহুব্যবহারে ক্লিশে হয়ে যাওয়া বাক্যটাই বলতে হয়, সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ৷

নারীকে মর্যাদা দেয়া হবে কী করে? সবই তো পুরুষকেন্দ্রিক৷ মায় ভাষা পর্যন্ত৷ ইংরেজি বা বাংলা, যে কোনো ভাষার দিকে তাকান৷ সব কিছুর মাপদণ্ড পুরুষ৷ বাংলায় আমরা কী বলি, ছেলেমানুষ, ছেলেবেলা, মেয়েছেলে, বিটিছেলে৷ ইংরেজিতে ম্যানকাইন্ড, চেয়ারম্যান৷ এরকম ঝুরি ঝুরি উদাহরণ আছে৷ ফরাসি চিন্তাবিদ ইরিগারে মনে করেন, শুধু পুরুষরা কেন সাবজেক্ট হিসাবে থাকবে, মেয়েদের সাবজেক্ট হতে হবে৷ কেন বলা হবে, পুরুষদের সমান অধিকার দিতে হবে মেয়েদের৷ এখানেও সেই পুরুষ প্রাধান্য৷ আর এখানেও যে নারীর মর্যাদা বা মেয়েদের মর্যাদা বলা হচ্ছে, সেটাও ঠিক নয়৷ কথাটা হওয়া উচিত মানুষের মর্যাদা৷

এই অধিকার প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল একটা ঘটনার কথা৷ বছর ২৬ আগের কথা৷ সবে দিল্লি এসেছি৷ তখন প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও৷ তার সফরসঙ্গী হয়ে ওড়িশার ভোট প্রচার দেখতে গেছি৷ প্রতিটি জনসভায় রাও মেয়েদের উদ্দেশে বললেন, আপনাদের আর চিন্তা নেই৷ পঞ্চায়েত, পুরসভায় এক তৃতীয়াংশ সংরক্ষণ চালু৷ এবার বিধানসভা ও লোকসভাতেও হবে৷ দেশ চালানোর ক্ষেত্রে মেয়েরা অগ্রাধিকার পাবে৷ তার বেশ কয়েক বছর পরের কথা৷ সংসদ ভবনে মেয়েদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণের দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন সব দলের নারী সাংসদরা৷ সেখানে সোনিয়া গান্ধী, সুষমা স্বরাজ থেকে অনেক সাংসদই আছেন৷ সেই বিক্ষোভ দেখছি৷ হঠাৎ পিঠে টোকা৷ পিছনে ঘুরে দেখি প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি৷ বললেন, ‘‘কী দেখছিস? ওটা তো আমাদের মৃত্যুবান৷ এটাও জেনে নে, কোনোদিন ওই সংরক্ষণ হবে না৷’’

সত্যিই হয়নি৷ সোনিয়া গান্ধী ইউপিএ আমলে চেষ্টা করেছিলেন৷ রাজ্যসভায় তাণ্ডব হলো৷ মার্শাল ডেকে কিছু সদস্যকে বের করতে হলো৷ কিন্তু লোকসভায় আর পাস করানোর চেষ্টা করেননি তিনি৷ মোদীর আমলে ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত হয়েছে, তিন তালাক বিল হয়েছে, জিএসটি পাস হয়েছে৷ এই সব কঠিন কাজ সহজে হয়ে গেছে, কিন্তু মেয়েদের এক তৃতীয়াংশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিল পাস হয়নি৷

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লি
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লিছবি: privat

কে আর সাধ করে মেয়েদের হাতে অধিকার তুলে দিতে চায়! মেয়েরা অধিকার পেলেও ছিনিয়ে নাও৷ পুরসভা বা পঞ্চায়েতে নারী প্রধান৷ কিন্তু হামেশাই অভিযোগ আসে, আসল ক্ষমতা তার স্বামীর হাতে৷ এই তো বেশ ভালো৷ অধিকার নিয়ে নাও৷ যত দোষ সব মেয়েদের দিয়ে দাও৷

দীপিকা পাড়ুকোন পদ্মাবত বলে একটা সিনেমা করলেন৷ তাঁকে ধর্ষণের হুমকি দেয়া হলো৷ সুশান্ত সিং রাজপুতের কথাই ধরা যাক৷ এখন তার কথা মানুষ প্রায় ভুলেই গেছে৷ বিহার নির্বাচনের আগে কী হইচই৷ তিনি আত্মহত্যা করেননি, তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠলো৷ সিবিআই, ইডি, নারকোটিকস ব্যুরো তদন্ত শুরু করলো৷ প্রতিদিন নানা খবর আসতে শুরু করলো৷ সব দায় গিয়ে পড়লো সুশান্তের বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীর উপর৷ সামাজিক মাধ্যমে, টিভির আলোচনাসভায় সকলেই একজন বিচারপতির ভূমিকা নিয়ে জানিয়ে দিলেন কে দোষী৷ অথচ, আমরা তো ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, যতক্ষণ পর্যন্ত দোষ প্রমাণ না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ দোষী নয়৷ সে সব কথা কে শুনছে৷ মেয়েদের ঘাড়ে দোষ ফেলা তো খুব সোজা কাজ৷ এমনকি বাঙালি মেয়েদের নামে সামাজিক মাধ্যমে বলা হতে লাগলো, তারা নাকি ব্ল্যাক ম্যাজিক জানে৷ কে আর কাকে মর্যাদা দেয়! মেয়ে হয়ে জন্মানো মানেই তো পুরুষদের হাতে হেনস্থা হওয়া৷ তাদের শ্রমের মর্যাদা থাকবে না৷ মেয়েদের বলা হবে, ছেলের জন্ম দিতে৷ মেয়ে হয়েছে জানলে তাকে জন্মাতেই দেয়া হবে না৷ এখনো দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ১৮ হওয়ার আগেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়, স্কুলে পাঠানোর সময় ছেলেরা অগ্রাধিকার পায়৷ আর মেয়েরা? তাদের এক টুকরো পৃথিবীতে না আছে নিরাপত্তা, না আছে মর্যাদা৷