মোদীর জার্মানি সফর ও ভারতের লাভ
৪ মে ২০২২করোনার জন্য গত দুই বছর কোনো বিদেশ সফরে যাননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সারা বিশ্বে করোনা পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হওয়ার পর তিনি প্রথম গন্তব্য হিসাবে বেছে নিলেন জার্মানিকে। শলৎস জার্মানির চ্যান্সেলর হওয়ার পর এই প্রথম মোদীর সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠক করলেন। শিল্প-বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক হলো। এমনকী রীতি ভেঙে শলৎস ও মোদীর সাংবাদিক সম্মেলনে কাউকে কোনো প্রশ্নও করতে দেয়া হয়নি। বার্লিনে মোদী অনাবাসী ভারতীয়দের সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন। সেখান থেকে 'মোদী, মোদী' ধ্বনি উঠেছে, যেমন বিদেশে ও দেশে হামেশাই ওঠে। ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো সেই সব খবর লাইভ দেখিয়েছে।
জার্মানিও মোদীকে বিপুলভাবে স্বাগত জানিয়েছে। যেখানে দেশে ও দেশের বাইরে অতি দক্ষিণপন্থি নেতাদের জার্মানির ক্ষমতাসীন দল সেভাবে স্বাগত জানায় না, সেখানে মোদী ছিলেন ব্যতিক্রম।
মোদীর বার্তা
সাবেক পররাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''নরেন্দ্র মোদীর পররাষ্ট্রনীতি হলো তার ঘরোয়া নীতির পরিবর্ধিত রূপ। তাই এই সফর থেকে মোদী কী পেলেন, তার থেকে বড় কথা হলো, দেশে তিনি কী বার্তা দিলেন। ভারতের সব চ্যানেল তার সফর লাইভ দেখিয়েছে। অন্য নেতাদের সেই সুবিধা নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো রাজনীতিক নন, তিনি সরকারি আমলা। তাই দেশের মানুষের কাছে মোদী বার্তা দিতে চেয়েছেন।''
যশবন্তের দাবি, ''অনাবাসী ভারতীয়দের কাছে তিনি যা বলেছেন, তার পুরোটাই পরিকল্পনামাফিক। ভারত সম্পর্কে তার ওই কথাগুলো থেকে দেশের মানুষের মনে একটা ধারণা হয়, মোদী যেন বিশ্বজয় করছেন। অথচ, মোদী ভারত নিয়ে যে দাবি করেছেন, তার অনেকগুলিই ঠিক নয়।''
প্রশ্ন হলো জার্মানিকেই কেন মোদী দুই বছর পর প্রথম গন্তব্য হিসাবে বেছে নিলেন? যশবন্ত মনে করেন, ''জার্মানি এখন অর্থনীতি ও প্রযুক্তির দিক থেকে ইউরোপের প্রধান দেশ। তারা বরাবর ভারতের বন্ধু দেশ। অতীতে কখনো জার্মানির সঙ্গে ভা্রতের কোনো বিষয় নিয়ে কোনো বড় বিরোধ লাগেনি। এখন জার্মানি সফর করা এবং নতুন চ্যান্সেলরের সঙ্গে বৈঠক করাটা তাই মোদীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ।'' ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, ''সাবেক চ্যান্সেলর ম্যার্কেল কখনই মোদীকে খুব বেশি গুরুত্ব দেননি। কিন্তু শলৎস দিচ্ছেন।''
যশবন্ত যখন ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে ছিলেন, তখন চার বছর জার্মানিতে কাটিয়েছেন। ভারতীয় দূতাবাসে ছিলেন। ফ্র্যাংকফুর্টে ভারতের কনসাল জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার দাবি, তিনি অনেক কূটনীতিকের থেকে জার্মানিকে ভালো চেনেন। তার মতে, জার্মানি যেহেতু ভারতের বন্ধু দেশ এবং প্রযুক্তি থেকে শুরু করে অনেক বিষয়েই এগিয়ে আছে, তাই ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে মোদীর কাছে জার্মানিকে বেছে নেয়াই স্বাভাবিক।
ভারতকে পাশে চায় জার্মানি
শুধু যে ভারতের জার্মানিকে দরকার তা নয়, জার্মানিরও নয়াদিল্লিকে পাশে পাওয়ার দরকার আছে। এমনটাই মনে করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক অনিন্দ্যজ্যোতি মজুমদার। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ''জার্মানির বর্তমান শাসকরা নির্বাচনী প্রচারের সময় থেকেই চীন-বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। ইউক্রেন সংকটের সময় দেখা গেছে, চীন ও রাশিয়ার সখ্য আরো জমাট বেঁধেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতকে কাছে পেতে চাইছে পশ্চিমা বিশ্ব। ভৌগলিক অবস্থান তার একটা কারণ, অন্য কারণ হলো, ভারতের বিশাল বাজার।''
অনিন্দ্যজ্যোতির মতে, ''জাতীয় রাজনীতিতে মোদীর ভাবমূর্তির সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতিক সম্পর্কে বিশেষ প্রভাব পড়ে না। তাছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাতের পর বিশ্বের রাজনীতি ও কূটনীতি আর আগের জায়গায় নেই।''
পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিশেষজ্ঞ সুগত হাজরা মনে করেন, ''ভারত এখনো রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেনি। জার্মানি গিয়েও মোদী রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি।'' ডয়চে ভেলেকে সুগত বলেছেন, ''তারপরেও মোদীকে এরকমভাবে স্বাগত জানিয়ে জার্মানি একটা কথা বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা ভারতকে পাশে চায়। ভারতের মতো এতবড় বাজার জার্মানি আর কোথাও পাবে না। তাছাড়া জার্মানি বুঝতে পারছে, ভারতের মতো বড় গণতান্ত্রিক দেশ ও উঠতি অর্থনৈতিক শক্তি তারা আর পাবে না।''
অর্থনৈতিক কারণ
যশবন্ত সিনহা বলেছেন, ''জার্মানি বরাবর বণিজ্যের ক্ষেত্রে আমাদের শরিক। তারা আমাদের প্রযুক্তিগত সাহায্য করে। ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে জার্মানি আমাদের বড় সহযোগী, তানিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই মোদীর জার্মানি যাওয়ার পিছনে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। তাছাড়া নতুন চ্যান্সেলরের সঙ্গে তার যোগাযোগ হওয়ার দরকার ছিল।''
যশবন্তের বক্তব্য, ''অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে তিনিও জার্মানি সফরে গেছিলেন। তখন চ্যান্সেলার ছিলেন হেলমুট কোল। সেই সফরও ছিল খুবই সফল। কিন্তু তানিয়ে বাজপেয়ী সরকার প্রচারের ঢাক পেটায়নি।''
মোদীর সফরের সময় জার্মানি ও ভারতের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি হয়েছে। গ্রিন এনার্জি-খাতে জার্মানি ১০ বিলিয়ান ডলার বিনিয়োগ করবে বলেও ঠিক হয়েছে। যোজনা কমিশনের সাবেক আমলা অমিতাভ রায় ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''গ্রিন এনার্জি করিডর, লে-হরিয়ানা ট্রান্সমিশন লাইন এবং লাদাখকে কার্বন নিউট্রাল করার জন্য দুই দেশের সমঝোতা হয়েছে। এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি জার্মানিরই আছে।''
রাশিয়া প্রসঙ্গে
যশবন্ত মনে করেন, ''ইউরোপে গিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন নিয়ে নিজের কথাটা সরাসরি বলার সুযোগ পেয়েছেন মোদী। জার্মানিও সেটা শুনেছে। কারণ, তারাও রাশিয়ার কাছ থেকে তেল ও গ্যাস কেনা বন্ধ করেনি। তাদের উপর প্রবল চাপ রয়েছে এই গ্যাস ও তেল কেনা বন্ধ করার জন্য।''
অমিতাভের বক্তব্য, ''শুধু তেল-গ্যাস-কয়লা নয়, রাশিয়ার কাছ থেকে জার্মানি নিকেল সহ তাদের বড় উৎপাদন শিল্পের জন্য প্রচুর কাঁচামাল নেয়। সুতরাং রাশিয়ার উপর তাদের নির্ভরশীলতা খুব চট করে কাটানো যাবে এমন নয়।''