মোদীর ভাষণে কেবলই হতাশা
২০ মার্চ ২০২০সন্ধে আটটা। অনেক আশা এবং আশঙ্কা নিয়ে টেলিভিশন সেটের সামনে বসেছিলেন ভারতবাসী। করোনার এই কঠিন পরিস্থিতিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দেশবাসীকে সুরক্ষিত রাখার পন্থা জানাবেন। মোদী বললেন, বক্তৃতা করলেন প্রায় আধঘণ্টা। কিন্তু তা শুনে আতঙ্ক তো কমলই না, বরং ছড়িয়ে পড়ল আরও প্রবল ভাবে।
আধঘণ্টার বক্তৃতায় নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, সংযম আর সংকল্পের কথা। তাঁর বক্তৃতার মূল বিষয় ছিল বিশ্ব জুড়ে করোনার এই প্রকোপের মধ্যে সকলকে সংযমী হতে হবে। থাকতে হবে ঘরের ভিতর। বিরত থাকতে হবে যে কোনও রকমের জমায়েত থেকে। তৈরি করতে হবে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বা সামাজিক দূরত্ব। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরে গোটা বিশ্ব জুড়ে সকলেই এ কথা গুলি বলছেন। এর বাইরে আরও একটি বিষয় ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। জানিয়েছেন, আগামী রবিবার সকাল সাতটা থেকে রাত ন'টা পর্যন্ত 'জনতার কার্ফু' পালিত হবে। অর্থাৎ, ওই সময়ের মধ্যে কেউ বাড়ি থেকে বেরতে পারবেন না। গোটা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন শহরে যে লকডাউন চলছে, তারই এক প্রতীকী রূপ বলা যেতে পারে এই জনতা কার্ফু।
প্রশ্ন উঠছে, এক দিন এই কার্ফু করে কী লাভ হবে? গোটা পৃথিবী জুড়ে যখন দিনের পর দিন ধরে লক ডাউন ঘোষণা হচ্ছে। বিভিন্ন কড়া নিয়ম জারি হচ্ছে, তখন এই এক দিনের প্রতীকী কার্ফুতে আদৌ কি সমস্যার কোনও সুরাহা হবে?
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরেই বিজেপির কর্মীরা দিকে দিকে বেরিয়ে পড়েছেন ২২ তারিখের কর্মসূচি সফল করতে। মানুষের দরজায় দরজায় গিয়ে তাঁরা বলছেন, জনতার কার্ফু সফল করুন। প্রশ্ন উঠছে, এই ঘোষণাও কি আরও পাঁচটা রাজনৈতিক কর্মসূচির মতোই? এ নিয়ে এ ভাবে প্রচার করা কি আদৌ সঙ্গত? বাড়ি বাড়ি এই প্রচারও কিন্তু ভাইরাস ছড়াতে পারে! পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির এক প্রথম সারির নেতার দাবি, ''মোদীজির কথা আমরা মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। যাতে মানুষ করোনা থেকে সতর্ক হন।'' তাঁর আরও বক্তব্য, রবিবারের আয়োজন পরীক্ষামূলক। সেটি সফল হলে জনতার কার্ফু আরও বাড়ানো হতে পারে।
বিরোধীরা অবশ্য বিজেপির এই যুক্তি মানতে নারাজ। সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম স্পষ্টই জানিয়েছেন, মোদীর বক্তৃতায় তিনি হতাশ। হতাশ দেশের মানুষও। তাঁর বক্তব্য, ''প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে শুনতে চেয়েছিলাম, করোনা থেকে মানুষকে বাঁচাতে সরকার কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু মোদীর বক্তৃতায় তার কোনও উল্লেখ নেই।'' বস্তুত বিরোধীদের বক্তব্য, মোদী যা বলেছেন, শুধু দেশ নয়, গোটা বিশ্বের মানুষ এখন তা জানেন। মোদী বলার অনেক আগে থেকেই মানুষ অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে বেরচ্ছেন না। সুযোগ থাকলে ঘরে বসে কাজ করছেন। কিন্তু যাঁদের উপায় নেই, যাঁরা দিন আনেন, দিন খান, তাঁদের কী হবে? এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে সরকার আর্থিক ভাবে কী ভাবে দাঁড়াবে মানুষের পাশে? করোনার সঙ্গে লড়াই করার জন্য কী কী পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে? কোথায় গেলে করোনার পরীক্ষা করানো যাবে? এ সব কোনও বিষয়েই আলোকপাত করেননি প্রধানমন্ত্রী। যা বলেছেন, তাতে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। কিন্তু তার সুরাহার কোনও বার্তা নেই।
কংগ্রেস বৃহস্পতিবার সকালেই কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করেছিল। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম সাংবাদিক বৈঠক করে বলেছিলেন, করোনা ঠেকাতে এই মুহূর্তে দেশ জুড়ে লক ডাউনের ব্যবস্থা করা হোক। এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাতায়াত যাতে বন্ধ হয়, তার ব্যবস্থা নেওয়া হোক। ভাইরাস ছড়ানোর সমস্ত ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শোনার পরে হতাশা প্রকাশ করেছে কংগ্রেসও।
বস্তুত, রাজনৈতিক মহলের একাংশ মোদীর বক্তৃতার সঙ্গে বেশ কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধানের বক্তৃতার তুলনা টেনে আনছেন। জার্মান চ্যান্সেলর, কানাডার প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর নাম উঠে আসছে বার বার। জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল রাখঢাক না করে জাতির উদ্দেশে ভাষণে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, দেশে আরও ভয়াবহ ভাবে ছড়িয়ে পড়বে ভাইরাস। বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট তাই বলছে। তা সত্ত্বেও করোনা ভাইরাস থেকে দেশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা তিনি ঘোষণা করেছিলেন। সাধারণ মানুষের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি নিয়েও যে সরকার ভাবছে, তাও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন ম্যার্কেল। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো লম্বা বক্তৃতায় স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, তাঁর সরকারের অবস্থান। করোনা প্রতিরোধে সরকার কী কী ব্যবস্থা করছে, তা বলার পাশাপাশি তিনি জানিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের ক্ষতি কী ভাবে মোকাবিলা করবে সরকার। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, পশ্চিম দেশের মতো পাকিস্তানে লক ডাউন সম্ভব নয়। কারণ, তাতে গরিব মানুষের পেটে টান পড়বে। ইমরান বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের পক্ষে সাধারণ মানুষকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব নয়। প্রত্যেকের বক্তৃতাতেই নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। রাজনৈতিক মহলের একাংশের বক্তব্য, মোদীর বক্তৃতায় কোনও নির্দেশ নেই। কেবল কিছু ভাল ভাল কথা আছে। তিনি বেসরকারি সংস্থার মালিকদের কাছে আবেদন করেছেন, কর্মীদের বেতন যেন কাটা না হয়। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে কী অবস্থান নিচ্ছে, তা জানাননি। দরকারি কথা না বলে বরং হাততালি দিয়ে আর থালা বাজিয়ে চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কর্মীদের ধন্যবাদ জানাতে বলেছেন। যা মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে করে। প্রধানমন্ত্রীকে বলে দিতে হয় না।
প্রধানমন্ত্রী যা-ই বলুন, ভারতে করোনা পরিস্থিতি ক্রমশ উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। মোট আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২০০। এখনও পর্যন্ত মৃত পাঁচ। ধীরে বিভিন্ন রাজ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। শুক্রবার ফের পশ্চিমবঙ্গে একজনের শরীরে করোনা মিলেছে। রাজস্থান, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্রে দ্রুত ছড়াচ্ছে ভাইরাস। রাজ্য সরকারগুলি নিজেদের মতো করে আইন তৈরি করছে। পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ব্রিটিশ আমলের মহামারি বিষয়ক আইন। রাজস্থানের বিভিন্ন জায়গায় ঘোষিত হয়েছে ১৪৪ ধারা। সাধারণ মানুষ বলছেন, করোনা পরীক্ষার জন্য ষথেষ্ট পরিকাঠামো এখনও তৈরি হয়নি। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সকলেই শুনতে চেয়েছিলেন, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে করোনা মোকাবিলায় সরকার কী কী ব্যবস্থা নিল। মোদীর ভাষণে অন্তত তার কোনও ইঙ্গিত মেলেনি।
এসজি/জিএইচ (পিটিআই, এএনআই, রয়টার্স)