জার্মানির সফলতম রাজনৈতিক দল
৭ জুলাই ২০১৭নাৎসি জার্মানির পতনের পর জার্মানিতে যখন একটি নতুন রাজনৈতিক ধারার প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন নাৎসি-পূর্ব ভাইমার প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন রাজনীতিক মিলে জার্মান রাজনীতির পুনর্বিন্যাসের জন্য সচেষ্ট হন৷ বিভিন্ন শহরে বিক্ষিপ্ত আলাপ-আলোচনা থেকে জন্ম নেয় একটি ঐক্যবদ্ধ ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন বা খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী সংঘ৷ তারিখটা ছিল ১৯৪৫ সালের ২৬শে জুন৷ মনে রাখতে হবে, সরকারিভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে তখনও মাস দু'য়েক বাকি৷
ভাইমার প্রজাতন্ত্রের আমলে গণতান্ত্রিক দলগুলির মধ্যে অনৈক্যের ফলেই নাৎসিরা ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়েছিল, এই ধারণা থেকেই ‘ইউনিয়ন' – অর্থাৎ সিডিইউ-সিএসইউ দলগুলির জন্ম৷ বিশেষ করে রোমান ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্টদের মধ্যে বিরোধ থেকে আডল্ফ হিটলারের উত্থান সম্ভব হয়েছে, বলে ইউনিয়ন দলগুলির নেতৃবর্গের ধারণা ছিল৷ সেই বিভেদ অতিক্রম করার জন্য উভয় সম্প্রদায়ের খ্রিষ্টানদের নিয়ে ও ‘সংঘ' নাম দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল সৃষ্টির প্রচেষ্টা করা হয়৷ সেই সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিচারে একটি উদারপন্থি-রক্ষণশীল ধারা৷ কনরাড আডেনাউয়ার ছিলেন এই সামগ্রিক মনোভাবের ধারক ও বাহক৷ ১৯৫০ সালের ২১শে অক্টোবর তারিখে সিডিইউ দলের প্রথম দলীয় সম্মেলনে তিনি দলের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন৷
জার্মানির পূর্বাংশ সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার ফলে গোড়ার দিকে সিডিইউ দলের কিছু সদস্য সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণার দিকে ঝুঁকলেও, ১৯৫০ সালে প্রথম দলীয় সম্মেলনের আগেই খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রীরা বহুলাংশে এ বিষয়ে একমত হন যে, ‘‘সামাজিক খোলাবাজারের অর্থনীতি'' জার্মানির পক্ষে সেরা পন্থা – অর্থাৎ খোলাবাজারের পুঁজিবাদের সঙ্গে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও কল্যাণরাষ্ট্রের সংমিশ্রণই দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক হবে৷
সিডিইউ দল ও তাদের বাভেরীয় ‘সহোদরা' ক্রিস্টিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন অর্থাৎ খ্রিষ্টীয় সামাজিক সঙ্ঘ বা সিএসইউ দল ১৯৪৯ সালের নির্বাচন ও পঞ্চাশের দশকের নির্বাচনগুলিতে বিপুল সাফল্য লাভ করে প্রধানত দু'টি কারণে: প্রথমত, দলের প্রথম দুই নেতা, কনরাড আডেনাউয়ার ও তাঁর উত্তরসুরি লুডভিশ এর্হার্ড; দ্বিতীয়ত, সিডিইউ দলের প্রতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী শক্তিদের, এক্ষেত্রে মার্কিন ও ব্রিটিশ সরকারের পরোক্ষ সমর্থন৷
চল্লিশের দশকের শেষেই পশ্চিমি শক্তিদের চোখে সামাজিক গণতন্ত্রী এসপিডি দল সিডিইউ দলের চেয়ে বেশি জাতীয়তাবাদী ও জার্মান পুনর্মিলনের পক্ষপাতী বলে বিবেচিত হতে শুরু করেছিল – প্রয়োজনে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সুযোগসুবিধা দিতেও এসপিডি দ্বিধা করবে না, বলে মিত্রশক্তিদের ধারণা ছিল৷ অপরদিকে সিডিইউ দলের অর্থনৈতিক ধ্যানধারণা ও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে আরো একটি শক্তি হিসেবে দলটি পশ্চিমি শক্তিদের সমর্থন পাচ্ছিল৷
আডেনাউয়ারের আমল
যুদ্ধপরবর্তী জার্মানিকে ধ্বংস থেকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়া ও জার্মানিকে ইউরোপীয় তথা পশ্চিমি দেশগুলির কাছে পুনরায় গ্রহণযোগ্য করে তোলার পিছনে কনরাড আডেনাউয়ার-এর অবদান জার্মানি তথা বিশ্বে সর্বজনস্বীকৃত৷ ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৩ সাল অবধি চ্যান্সেলর ছিলেন আডেনাউয়ার – তথাকথিত ‘জার্মান অর্থনৈতিক আশ্চর্যের' সূচনা তাঁরই কর্মকালে৷ ১৯৫২ সালে ইউরোপীয় কয়লা ও ইস্পাত সমিতি গঠনে সংশ্লিষ্ট ছিলেন আডেনাউয়ার – যা কিনা ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক পূর্বসুরি বলে গণ্য করা যায়৷ ১৯৫৫ সালে ‘বুন্ডেসভের' নাম দিয়ে নতুন জার্মানি সেনাবাহিনি সৃষ্টিও তাঁর কাজ৷ আডেনাউয়ারের পর চ্যান্সেলর হন লুডভিশ এরহার্ড, যাঁকে ‘জার্মান অর্থনৈতিক আশ্চর্যের' জনক বলা হয়ে থাকে এবং যিনি চ্যান্সেলর হবার আগে আডেনাউয়ারের মন্ত্রীসভায় অর্থমন্ত্রী ছিলেন৷ এরহার্ড চ্যান্সেলর ছিলেন ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ সাল অবধি৷ তাঁর পরে চ্যান্সেলর হিসেবে আসেন কুর্ট গেয়র্গ কিসিংগার, যিনি ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল অবধি ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন৷ অতঃপর সিডিইউ দলকে পুনরায় চ্যান্সেলর পদাভিষিক্ত হবার জন্য দীর্ঘ ১৩ বছর অপেক্ষা করতে হয়৷
হেলমুট কোল-এর আমল
তবে সে প্রতীক্ষা স্বার্থক হয়, বলা চলে৷ সদ্য প্রয়াত হেলমুট কোলকে দুই জার্মানির পুনর্মিলনের জনক বলা হয়ে থাকে৷ দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে তিনি প্রথমে পশ্চিম জার্মানি, অতঃপর পুনরেকীকৃত জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন৷ অপরদিকে আডেনাউয়ারের ‘পৌত্র' প্রজন্মের রাজনীতিক হেলমুট কোল ছিলেন ‘পিতামহের' মতোই ইউরোপীয় ঐক্যের ধারণার ধারক ও বাহক – স্ট্রাসবুর্গের পার্লামেন্টে প্রথম ইউরোপীয় রাজনীতিক হিসেবে তাঁর জন্য বিশেষ শোকানুষ্ঠান যার প্রমাণ৷
কোল ও তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া মিতেরঁ-র মধ্যে সখ্যতা যে শুধু জার্মান পুনর্মিলনের পথ খুলে দিয়েছিল, শুধু তাই নয়; অতঃপর ইউরো মুদ্রার প্রচলন থেকে শুরু করে শেঙেন চুক্তি বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্বমুখী সম্প্রসারণ – এক কথায় ইইউ বলতে মানুষ আজ যা কিছু বোঝে, তার সব কিছুর পিছনেই কাজ করেছে ঐ ফরাসি-জার্মান মৈত্রী, যা এমন একটি ধারা, যা হালের ম্যার্কেল-ম্যাক্রোঁ সম্পর্কেও অটুট আছে৷
আঙ্গেলা ম্যার্কেলের আমল
হেলমুট কোল ১৯৮২ থেকে ১৯৯৮ সাল অবধি জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন৷ সাবেক পূর্ব জার্মানির যে সিডিইউ রাজনীতিককে তিনি তাঁর উত্তরসুরী হিসেবে অজান্তেই গড়ে দিয়েছিলেন, তিনি হলেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল, যিনি ২০০৫ সাল থেকে জার্মানির চ্যান্সেলর পদে অধিষ্ঠিত – এবং জরিপ বলছে যে, আগামী সেপ্টেম্বরের সংসদীয় নির্বাচনে তাঁর একটি চতুর্থ কর্মকাল প্রাপ্তির সম্ভাবনা কম নয়৷ অপরদিকে যাকে একদিন কিছুটা তাচ্ছিল্য করে ‘কোল-এর খুকি' বলা হত, তিনি আজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাস্তবিক নেতা, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নারী ও স্বাধীন বিশ্বের নেত্রী হিসেবে বর্ণিত ও বিবেচিত হচ্ছেন৷
রক্ষণশীল কিন্তু বাস্তববাদী
খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী ইউনিয়ন বা সিডিইউ একটি রক্ষণশীল দল – রাজনৈতিক বিচারে তারা নিজেদের ‘মধ্যম-ডান' বলে থাকে৷ একটি ‘ফল্কসপার্টাই' বা গণদল হিসেবে দলের জনসমর্থনের প্রশস্ত ভিত্তি বজায় রাখাই হল দলের সর্বোচ্চ লক্ষ্য৷ নয়তো অপরাধীদের দণ্ডদানের মাত্রা বৃদ্ধি থেকে শুরু করে দেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদের ঘটনায় সেনাবাহিনীকে নিয়োগ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রসঙ্গে দলের রক্ষণশীল মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়৷ অপরদিকে বিপুল সংখ্যায় উদ্বাস্তু আগমন সত্ত্বেও আঙ্গেলা ম্যার্কেল দলের খ্রিষ্টীয় কর্তব্যের দোহাই দিয়েছেন ও কোনো সর্বোচ্চ সংখ্যা নির্দিষ্ট করতে অস্বীকার করে এসেছেন৷ সিডিইউ দল চায় যে, বহিরাগতরা জার্মান ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হোন ও জার্মান সমাজের অঙ্গ হয়ে উঠুন৷ বিদেশনীতির ক্ষেত্রে সিডিইউ দল ইউরোপীয় সংহতির সমর্থক – অপরদিকে সিডিইউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে বিশ্বাস করে৷ সিডিইউ দল বর্তমান পরিস্থিতিতে তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্ণ সদস্য হওয়ার বিরোধী৷