সুবহানের মৃত্যুদণ্ড, কামারুজ্জামানের ফাঁসির পূর্ণাঙ্গ রায়
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাবনা জেলায় যুদ্ধাপরাধের দায়ে আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে আনা ৯টি মানবতাবিরোধী অভিযোগের মধ্যে গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ষড়যন্ত্রের ৬টি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে বুধবার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল৷ ট্রাইব্যুনাল ২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম এই রায় ঘোষণা করেন৷ ১৬৫ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান৷ রায় ঘোষণার সময় সুবহান ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন৷
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হলে সুবহান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে পাবনা জেলায় হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট শুরু করেন৷ পরে পাবনা জেলা শান্তি কমিটির সম্পাদক এবং পরবর্তীতে ভাইস চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন জামায়াতে ইসলামীর এই নায়েবে আমির৷ তার নেতৃত্বেই পাবনা জেলার শান্তি কমিটি, রাজাকার-আল-বদর, আল-শামস ও মুজাহিদ বাহিনী গঠিত হয়৷
রায়ে উল্লেখ করা হয়, উর্দুতে কথা বলতে পারদর্শী হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই জামায়াত নেতা পরিণত হন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যন্ত আস্থাভাজন এক সহযোগীতে৷ জানা যায়, স্বাধীনতাযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সুবহানের ভূমিকা ছিল নীতিনির্ধারকের৷
অভিযোগ, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সুবহান পাবনার বিভিন্ন থানায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের নামের তালিকা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে সরবরাহ করতেন৷ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে থেকে হত্যা-গণহত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে অংশও নিতেন আবদুস সুবহান৷
ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে মিটিং করে স্বাধীনতাবিরোধী বক্তব্য দেওয়া এবং পাকিস্তান সরকারের পক্ষে মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে স্লোগান দেওয়া ছিল এই জামায়াত নেতার অন্যতম কাজ৷ পরে অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে একাত্তরের ৪ঠা ডিসেম্বর ইয়াহিয়া সরকারের পতন দেখে গোলাম আযমের সঙ্গে পাকিস্তানে পালিয়ে যান মাওলানা সুবহান৷
২০১২ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর সকালে টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্ত থেকে সুবহানকে আটক করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷ ওই রাতেই তাকে পাবনা কারাগারে নেওয়া হয়৷ ২৬শে সেপ্টেম্বর পাবনা কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয় সুবহানকে৷ আর ৩০শে সেপ্টেম্বর প্রসিকিউশনের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আমলে নিয়ে সুবহানকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় ট্রাইবুন্যাল৷
পাবনা শহরের পাথরতলা মহল্লার মৃত নঈমুদ্দিনের ছেলে মাওলানা আবদুস সুবহান এলাকায় পরিচিত ‘মাওলানা সুবহান’ নামে৷
কামারুজ্জামানের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ৷
আপিল বিভাগের বিচারপতি (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) এস.কে. সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির বেঞ্চ কামারুজ্জামানের আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ এ রায় দেন৷ বেঞ্চের অন্য তিনজন সদস্য হচ্ছেন বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী৷
বুধবার দুপুর একটা ৫৫ মিনিটে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে ৫৭৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয়৷ এর আগে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে চার বিচারপতি ঐ রায়ে স্বাক্ষর দেওয়া শেষ করেন৷
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের দিন থেকে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করার জন্য ১৫ দিনের সময় পাচ্ছেন আসামিপক্ষ৷
গত বছরের ৩রা নভেম্বর কামারুজ্জামানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২-এর দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় সংক্ষিপ্ত আকারে দেয় আপিল বিভাগ৷
‘রিভিউয়ের জন্য অপেক্ষা করবে না রাষ্ট্রপক্ষ’
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের এখন রিভিউ আবেদনের জন্য ১৫ দিন সময় পাওয়ার কথা৷ কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘‘রিভিউ আবেদনের জন্য ১৫ দিনের সময় থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষ এ সময়ের জন্য অপেক্ষা করবেন না৷’’ তিনি বলেন, ‘‘ধরেন কেউ যদি রিভিউ না করে, তাহলে রাষ্ট্র কি বসে থাকবে?’’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘‘কামারুজ্জামানের মামলার ব্যাপারে আমাদের এতদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটলো৷ রায় পাওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল পরোয়ানার আদেশ জেলে পাঠালে সরকারের পক্ষে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন ঠিক করতে কোনো অসুবিধা নেই৷’’
মাহবুবে আলম বলেন, ‘‘রিভিউয়ের ১৫ দিনের হিসাব আজ (বুধবার) থেকেই শুরু হবে৷ এই ১৫ দিন রাষ্ট্রকে অপেক্ষা করতে হবে বলে আপিল বিভাগ রিভিউয়ের রায়ে বলেনি৷ তবে রিভিউ আবেদন দায়ের করলে দণ্ডাদেশের কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে যাবে৷’’
তিনি জানান, ‘‘আজকের (বুধবার) ভেতরে পূর্ণাঙ্গ রায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে৷ এরপর ট্রাইব্যুনাল কারাগারে মৃত্যু পরোয়ানা পাঠাবে৷ সেটা ট্রাইব্যুনাল আজও করতে পারে, কালও করতে পারে৷’’
রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়ে মাহবুবে আলম বলেন, ‘‘প্রাণভিক্ষার অধিকারটা সব সময় দেওয়া হয়৷ রিভিউয়ের আগেও তিনি সেটা চাইতে পারেন৷ তবে স্বাভাবিকভাবে আইনি প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরই প্রাণভিক্ষা চাওয়ার নিয়ম৷’’