যুবলীগ নেতার মামলায় গ্রেপ্তার প্রথম আলোর সাংবাদিক
২৯ মার্চ ২০২৩তার বিরুদ্ধে ঢাকার তেজগাঁ থানায় মামলা করেছেন ঢাকার কল্যাণপুর এলাকার বাসিন্দা ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম কিবরিয়া।
এদিকে আটকের পর থেকে তার পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে কথা বলতে বা যোগাযোগ করতে পারেননি। তার মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিয়ে গেছেন বলে তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিষ্ট্রার উম্মে ইসলাম জানিয়েছেন। আটক সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বড় ভাই ২০১৬ হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার সময় নিহত পুলিশের এএসপি রবিউল করিম।
শামসুজ্জামান প্রথম আলোর সাভার এলাকার প্রতিবেদক। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে তার একটি সংবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন একটি শিশুর ছবি অনলাইনে কার্ড আকারে প্রকাশ হওয়ার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রথম আলো অবশ্য ওই কার্ডটি ওই দিনই অনলাইনে প্রকাশের ১৭ মিনিট পর সরিয়ে নেয়।
মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে," ২৬ মার্চ প্রথম আলোর অনলাইনে দেখা যায় একটি শিশু ফুল হাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফটকে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিবেদনে শিশুটির নাম জাকির হোসেন বলা হয়। শিশু জাকির হোসেন বলে- ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কি করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব'। সামাজিক মাধ্যমে সংবাদটি ভাইরাল হয়ে যায়। ওই সংবাদটি দেশ বিদেশে অবস্থানরত হাজার হাজার মানুষ তাদের ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ক্রিনশটসহ শেয়ার করেন। এই ঘটনায় বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের সোনালী গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণসহ বহিঃবিশ্বে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।” এজহারে আরো অভিযোগ করা হয়, প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, প্রথম আলো উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মিথ্যা পরিচয় ও মিথ্যা উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদটি পরিবেশন করেছে। যে শিশুটির কথা প্রথম আলোর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে তার সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে শিশুটির নাম জাকির হোসেন নয় সবুজ আহমেদ।
পুলিশ প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে বলেছে, "সাংবাদিক শামসুজ্জামান প্রথম আলো পত্রিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে মিথ্যা এবং বানোয়াট তথ্য ও ছবিযুক্ত সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে মানহানিকর তথ্য প্রচার ও প্রকাশ করেছে। তার এই কাজ দেশের আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি ও সহায়তা করার অপরাধ ।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৫২(২),২৬(২), ২৯(১), ৩১(২) ও ৩৫(২) ধারায় মামলটি হয়েছে।
মামলার বাদী মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন,"আমি কল্যাণপুর-পাইকপাড়া ১১ নাম্বার ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। তবে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই মামলা করিনি। পুলিশ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। রাত ১০টায় আমি নিজেই থানায় যাই মামলা করতে। আমাকে বসিয়ে রেখে রাত ২টার পর মামলা নেয়া হয়।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আমি আগে মামলা করিনি কারণ আমি ভেবেছি প্রথম আলোর খবরটি সত্য। পরে একাত্তর টিভিতে দেখলাম খরটি সত্য নয়। আমি দেশের বিরুদ্ধে এই অপপ্রচার মেনে নিতে পারিনি তাই মামলা করেছি।”
শামসুজ্জামানের বড় ভাইয়ের স্ত্রী উম্মে ইসলাম বুধবার দুপুরের পর জানান, "শামসুজ্জামান সাভারের আমতলা এলাকার বাসায় একাই থাকেন। ভোর রাতে তাকে আটকের পর সাকালে অফিসে গিয়ে আমি জানতে পারি। আটকের সময় যারা দেখেছেন তারা আমাদের জানিয়েছেন, তিনটি মাইক্রোবাসে এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। একটি মাইক্রোবাসে নাম্বার প্লেট ছিল না। সেই মাইক্রেবাসেই তাকে তোলা হয়। পরে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে জানতে পারি তাকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। বাসায় তল্লাশি করেছে। তার ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনও নিয়ে গিছে। তার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতে পারিনি। পুলিশের পক্ষ থেকেও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি।”
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, "ভোর চারটার দিকে তাকে সিআইডি পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়।”
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দুপুরের পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন,"আইন কিন্তু নিজস্ব গতিতে চলে। আইন অনুযায়ী, সমস্ত কিছু চলে, রাষ্ট্র বলেন সবকিছু চলে। কেউ যদি সংক্ষুব্ধ হয়ে বিচার চায়, সংক্ষুব্ধ হয়ে থানায় মামলা রুজু করে সেই অনুযায়ী পুলিশ কিন্তু ব্যবস্থা নিতেই পারে।” স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, "প্রথম আলোর সাংবাদিকসহ যিনি উদ্ধৃতিটা করেছেন সেটি সঠিক ছিল না, যেটা নাকি একাত্তর টিভির মাধ্যমে আপনারাই প্রচার করেছেন। আপনারাই সাংবাদিক ভাইয়েরা সংক্ষুব্ধ হয়ে একাত্তর টিভির মাধ্যমে এই সংবাদটা যে ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে এটা একাত্তর টিভিতে এটা সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।”
এনিয়ে আইন ও সাালিশ কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার কর্মী নূর খান বনেন, "সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে যে প্রক্রিয়ায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
তার কথা,"কেউ অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে মামলা হতেই পারে। প্রয়োজনে গ্রেপ্তারও করা যেতে পারে। কিন্তু তিনি একজন সাংবাদিক। আর প্রথম আলো সংবাদটি প্রত্যাহার করে ভুল স্বীকার করেছে তারপর এই প্রক্রিয়ার গ্রেপ্তার গ্রহণযোগ্য নয়। এর মাধ্যমে বাক স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আরো সংকুচিত হবে। এর মাধ্যমে একটি ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হবে।”
আর বাক স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা আর্টিক্যাল নাইনটিন-এর দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান ফারুক ফয়সাল বলেন," এখন শুধু সাংবাদিক নয়, সরকার যাকে ধরতে চাইছে সবার বিরুদ্ধেই এই আইনটি ব্যবহার করছে। আমরা এই আইনটি বাতিল চাই।” তার কথা," এই আইনটি বাক স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
তবে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. ওমর ফারুক বলেন," কেউ যদি অপরাধ করে তার বিরুদ্ধে তো আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। একসময় স্বাধীনতার পর বাসন্তীকে জাল পরিয়ে অপ্রচার করা হয়েছে। একইভাবে এখন পরিকল্পিতভাবে অসত্য ছবি ও নিউজ নিয়ে দেশের সুনাম নষ্ট করা হচ্ছে। ওই সাংবাদিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এখন আমাদের কিছু করার নেই। তবে সে যদি নির্দোষ হয় তাহলে আমরা তার পাশে থাকব।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার কেন? জানাতে চাইলে তিনি বলেন, "এই আইনের আটটি ধারা আমরা বাতিল চেয়েছি। কিন্তু আমাদের পাশে কাউকে তখন পাইনি। ফলে এখন আইনটি তো আছে।”
ছবিটি প্রত্যাহার করার পর মামলার প্রয়োজন কেন হলো, প্রেস কাউন্সিল আইনেও তো মামলা করা যেত? জবাবে তিনি বলেন, "প্রত্যাহার করলেও তো ওই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাল হয়েছে। এখনও হচ্ছে।”