যে কারণে উল্টো নিয়মে চালাতে হয় ট্রেন, প্রাণ যায় যাত্রীদের
২৫ অক্টোবর ২০২৩যে মালবাহী ট্রেনটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেই ট্রেনটির ইঞ্জিন ছিল উল্টো দিকে৷ ট্রেনটির সামনের দিকে ছিল বগি আর পেছনে ছিল ইঞ্জিন৷ চালক পেছন দিক থেকে চালিয়ে ট্রেনটি সামনের দিকে নিচ্ছিলেন৷ সেই কারণেই তিনি সিগনাল দেখতে পারেননি বলে ধারণা অনেকের৷
তবে ওই একটি ট্রেন নয়, আরো অনেক ট্রেনের ইঞ্জিনই নাকি এখন উল্টো দিকে চলে৷ চালক পেছনের দিকে থেকে ট্রেন সামনের দিকে চালান৷ তার চোখের সামানে ফাঁকা রেলপথ নয়, থাকে ইঞ্জিন এবং সারি সারি বগি৷ এটা যেন এখন সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে৷ এর কারণ হলো ট্রেনের ইঞ্জিন টেনে সামনে নিয়ে লাগানোর জন্য যে টার্ন টেবিল (ইঞ্জিন ঘোরানোর টেবিল) সেগুলোর প্রায় সবগুলোই এই মুহূর্তে নষ্ট৷ ফলে চালকদের এভাবে ঝুঁকি নিয়েই চালাতে হয়৷
গত ১৬ অক্টোবর এ নিয়ে চালকদের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম রেল কর্তৃপক্ষকে চিঠিও দেয়া হয়৷ বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও কর্মচারি ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ওই চিঠিটি দেয়া হয়৷ তাতে বলা হয়, অনেক দিন ধরেই ঢাকা লোকোশেডের টার্ন টেবিলগুলো নষ্ট হয়ে আছে৷ ফলে বিভিন্ন সিরিজের একমুখি ট্রেনগুলোর ইঞ্জিন পেছনে রেখে চালাতে হচ্ছে৷ এ কারণে তারা ঝুঁকির মুখে রয়েছেন৷ অনেক সময়ই নিরাপদ দূরত্ব থেকে সিগনাল, লেভেল ক্রসিং ঠিকমতো দেখা যায় না৷ ফলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে৷
চিঠিতে আরো বলা হয়, শীত মৌসুমে কুয়াশার কারণে এই ঝুঁকি আরো বেড়ে যাবে৷ তাই তারা টার্ন টেবিল মেরামতের আবেদন জানান৷
তাদের এই চিঠির প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম রেলের বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (লোকো) সাজিদ হাসান নির্ঝর চট্টগ্রামের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলীকে টার্ন টেবিল মেরামতের জন্য চিঠি লেখেন ২২ অক্টোবর৷ তিনি তার চিঠিতেও দুর্ঘটনার ঝুঁকির কথা বলেন৷ ঠিক পরের দিন, অর্থাৎ ২৩ অক্টোবরই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটে৷ ভৈরব স্টেশনের আউটারে যাত্রীবাহী এগারসিন্দুর গোধূলি এক্সপ্রেসে উল্টো ইঞ্জিনের মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ যায় ১৭ জনের৷
বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘‘ধরেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে একটি ট্রেন গেল৷ ইঞ্জিনটি সামনে আছে৷ এখন ওই ট্রেনটি আবার ঢাকা আসার সময় শুধু ইঞ্জিনটি ঘুরিয়ে আবার ঢাকার দিকে সামনে লাগানো হবে৷ ট্রেনের বগি তো আর ঘোরানোর সুযোগ নেই৷ ইঞ্জিন ঘুরিয়ে আবার সামনে নিয়ে লাগানোর জন্য একটি টার্ন টেবিল ব্যবহার করা হয়৷ ওই টেবিলে করে ইঞ্জিনটি সামনে নিয়ে লাগানো হয়৷ কিন্তু টার্ন টেবিল নষ্ট হলে আর ইঞ্জিন ঘোরানো যায় না৷ ফলে ট্রেনটি পিছন দিক থেকে চালাতে বাধ্য হন চালকরা৷’’
তার কথা, ‘‘যে-কোনো যানবাহনের চালক থাকবে সামনে৷ কিন্তু এই টার্ন টেবিল অকেজো থাকায় ট্রেনের চালক থাকেন পিছনে৷ তার সামনে থাকে ইঞ্জিন ও বগি৷ ফলে তিনি সামনে সিগনাল না-ও দেখতে পারেন৷ ভৈরবের ক্ষেত্রে এরকম ঘটতে পারে৷ বলা হচ্ছে, চালক সিগনাল মানেননি৷ কিন্তু তিনি তো পেছনে বসে ট্রেন চালাচ্ছিলেন৷ তার সামনে ছিল ইঞ্জিন ও বগি৷ ফলে সিগনাল দেয়ার পর তার না দেখার সম্ভাবনা আছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘ট্রেনে দুইজন চালক থাকেন৷ তারা সামনের দিকে থাকলে সামনেটা তো ফাঁকা থাকে, ফলে সিগনাল, লেভেল ক্রসিং সবই দেখতে পান৷ কিন্তু পেছনের দিকে থাকলে একজন চালক কিছুই দেখবেন না৷ আরেকজন চালক যিনি সিগনালের দিকে থাকেন, তিনি হয়ত দেখবেন৷ তবে নানা কারণে যেমন গাছপালা, কুয়াশা বা অন্য কোনো কারণে তিনিও না দেখতে পারেন৷’’
বুয়েটের এই সহকারী অধ্যাপক বলেন, ‘‘সব বড় স্টেশন বা জংশনেই যেখানে ট্রেন ঘুরাতে হয়, সেখানেই টার্নিং টেবিল আছে৷ কিন্তু আমার জানা মতে অধিকাংশ টেবিলই অকেজো৷ ফলে আমরা প্রায়ই দেখি, চালক উল্টা দিক থেকে ট্রেন চালাচ্ছেন৷ আমরা দেখছি রেলের উন্নয়নে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে, কিন্তু টার্নিং টেবিল মেরামতের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হচ্ছে না৷ এই উন্নয়ন দিয়ে কী হবে!’’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য রেলমন্ত্রী, রেল সচিব, রেলের মহাপরিচালক থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম রেলের দয়িত্বশীল কাউকেই ফোনে পাওয়া যায়নি৷ তবে নাম প্রকাশ না করে রেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘‘টার্ন টেবিলগুলো অনেক দিন ধরেই নষ্ট৷ এগুলো মেরামতের কোনো চেষ্টাও নেই৷ এখন দুর্ঘটনা ঘটলো বলেই আলোচনায় এসেছে৷ এ রকম আরো অনেক জরুরি জিনিস অকেজো হয়ে পড়ে আছে রেলে৷’’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘পুরো রেলটাই এখন উল্টো দিকে চলছে৷ পেছনের দিকে চলছে৷ রেল লাইন নষ্ট, ইঞ্জিন নষ্ট, কোচ নষ্ট, টার্ন টেবিল নষ্ট৷ কিছুই মেরামত হচ্ছে না৷ অথচ রেলের পেছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে৷ এখানে টেবিলে টেবিলে কালো বিড়াল৷ উন্নয়নের টাকা তাদের পকেটে চলে যাচ্ছে৷’’
তার কথা, ‘‘এই প্রতিষ্ঠানে কোনো জবাবদিহিতা নেই৷ এখানে চলছে দুর্নীতির মচ্ছব, যার বলি হচ্ছেন যাত্রীরা৷ ভৈরবে দুর্ঘটনার দিন আমরা জানলাম রেল মন্ত্রী, সচিব, ডিজি সবাই বিদেশে৷ তাহলে প্রশ্ন হলো, সবাই বিদেশে থাকলে রেল চলবে কীভাবে?’’