যে গ্রামের শিশুদের কখনোই টিকা দেওয়া হয়নি
১৮ জুলাই ২০১৭এই গ্রামটি হলো চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের ত্রিপুরা পাড়া৷ সেখানে ৮৫টি বাড়িতে ৩৮৮ জন নারী পুরুষ ও শিশুর বাস৷ তাদের মধ্যে ১৭৬ জনের বয়স ২০ বছরের নীচে৷ তারা কোনোদিনই শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আসেনি৷ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ সংবাদমাধ্যমকে জানান, ‘‘দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ওয়ার্ডভিত্তিক পরিকল্পনা অনুযায়ী টিকাদান কর্মসূচি পালিত হয়৷ কিন্তু সীতাকুণ্ড উপজেলায় সোনাইছড়ি ইউনিয়নের তালিকায় ত্রিপুরা পাড়ার নাম উল্লেখ নেই৷ ম্যালেরিয়া অন্যান্য কয়েকটি রোগ প্রতিরোধ প্রকল্পের আওতায় থাকলেও ত্রিপুরা পাহাড়ের ন'টি এলাকায় ৩৮৮ জন মানুষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ টিকাদান কর্মসূচির বাইরে ছিল৷ এ কারণে সেখানে কোনো টিকাদান কার্যক্রম ছিল না৷''
তিনি আরো জানান, ‘‘মাইক্রোপ্ল্যান ম্যাপেও ত্রিপুরা পাড়া উল্লেখ নেই৷ এ কারণে ত্রিপুরা পাড়ায় টিকাদান কার্যক্রম ছিল না৷ ফলে সীতাকুণ্ডে হামে আক্রান্ত হয়ে মারা এ সব শিশু৷ অথচ এ জন্য স্বাস্থ্য মহাপরিচালক দায় স্বীকার না করে শুধু দুঃখ প্রকাশ করেন৷''
সীতাকুণ্ডে ৮ জুলাই প্রথম একটি শিশু মারা যায়৷ এরপর ৯ জুলাই মারা যায় দু'টি শিশু৷ ১১ জুলাই একটি ও ১২ জুলাই চারটি শিশুর মৃত্যু হয়৷ পরে হাসপাতোলে আরো একটি মিশু মারা গেলে মোট মৃতের সংখ্যা দাড়ায় ন'য়ে৷
সংবাদমাধ্যমে এ খবর প্রকাশের পর আইইডিসিআর-এর পাঁচ সদস্যের টিম সেখানে যায়৷ আক্রান্ত শিশুদের দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে৷ পরে ল্যাব টেস্টে দেখা যায়, আক্রান্ত ও মৃত শিশুরা হাম রোগের জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়েছিল৷ শুধু তাই নয়, পুষ্টিহীনতাতেও ভুগছিল তারা৷ এ কারণে একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছিল৷ অপুষ্টির কারণে সংক্রমণ তীব্র আকার ধারণ করেছিল৷ এরপরও ঠিক সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকত না৷
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘স্থানীয়ভাবে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই টিকাদানের মাইক্রোপ্ল্যান ম্যাপ তৈরি করা হয়৷ সেই তথ্য পাওয়া যায়নি বলেই ঐ গ্রামটিতে স্বাধীনতার পর থেকে কোনো টিকাদান কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়নি৷ তাই দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ছ'জন স্বাস্থ্য মাঠ কর্মীকে বদলি করা হয়েছে৷''
তিনি দাবি করেন, ঐ এলাকার অধিবাসীরা টিকা নিতে চাইতেন না, তাঁরা তাঁদের স্থানীয় টোটকা চিকিৎসায় বিশ্বাসী ছিলেন৷ এটা জানার পর মাঠ কর্মীরা সে কথা ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের জানায়নি৷ তাঁদের অবহেলা এটাই৷ এ কারণে তাঁদের বদলি করা হয়েছে৷ যদি এমন হতো যে তাঁরা টিকা কর্মসূচির আওতায় আসতে চাওয়ার পরও আনা হয়নি, তাহলে ঐ ছ'জনকে চাকরিচ্যুত করা হতো৷''
স্বাস্থ্য মহাপরিচালক দাবি করেন, ‘‘একটি শিশু মারা যাওয়ার পর তাঁরা মশাল জ্বালিয়ে প্রার্থনা করে রোগ দূর করার চেষ্টা করেন৷ অথচ চিকিৎসকের কাছে যাননি৷''
জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি প্রকল্পের প্রধান ডা. মো. জাহাঙ্গির আলম সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি একটি সফল প্রকল্প৷ সারা বিশ্বে প্রশংসিত৷ আমরা বিনামূল্যে ১০টি রোগের ১১টি টিকা দিই৷ আর এটা ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত ম্যাপ করে দেওয়া হয়৷ সেইক্ষেত্রে পুরো একটি গ্রাম স্বাধীনতার পর থেকে এই কর্মসূচির বাইরে থাকা দুঃখজনক৷ তাছাড়া গ্রামটি দুর্গম কোনা এলকাতেও নয়, চট্টগ্রাম শহরের কাছেই৷ আমরা তদন্ত করে দেখছি যে এটা কীভাবে হলো৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমরা এ রকম আরো কোনো গ্রাম বা এলকা আছে কিনা তাও দেখতে চাচ্ছি৷ এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা সেটা জানতে পারব৷''
এদিকে ন'টি শিশুর মুত্যুর পর ত্রিপুরা পাড়া নিয়ে এখন তোড়জোর পড়ে গেছে৷ সিভিল সার্জন জানান, ‘‘আমরা এরইমধ্যে অস্থায়ীভাবে টিকাদান ও পুষ্টিকেন্দ্র খুলেছি৷ স্যাটেলাইট ক্লিনিক চালু করেছি৷ এখন আর কোনো সমস্যা নাই৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে৷''