বিচারহীনতার কারণ অনুসন্ধান
২২ নভেম্বর ২০১৬সম্প্রতি একটি মামলায় খালাসের ঘটনা বেশ সমালোচিত হয়েছে৷ গৃহকর্মী এক শিশুকে নির্যাতনের মামলায় সস্ত্রীক খালাস পেয়েছেন ক্রিকেটার শাহাদাৎ হোসেন রাজীব এবং তাঁর স্ত্রী জেসমিন জাহান নিত্য৷
গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর পুলিশ হ্যাপী নামে এক গৃহকর্মীকে নির্যাতনের অভিযোগে ঢাকার মিরপুর থানায় ক্রিকেটার শাহাদাৎ ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করে৷ ঐ শিশুটিকে নির্যাতনের পর রাস্তায় ফেলে দেয়া হয়েছিল৷ তাকে উদ্ধারের পর সে পুলিশের কাছে নির্যাতনের বর্ণনাও দেয়৷ ঐ মামলায় শাহাদাৎ এবং তাঁর স্ত্রীকে কারাগারে পাঠানো হলেও পরে তাঁরা জামিন পান৷ এই মামলায় পুলিশ আদালতে দু'জনের বিরুদ্ধে চার্জশিটও দেয়৷ কিন্তু মামলার বিচারে গত ৬ নভেম্বর শাহাদাৎ ও তাঁর স্ত্রীকে খালাস দেন ঢাকার একটি আদালত৷
আদালতে নির্যাতনের ঘটনা প্রমাণ হলেও আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়নি৷ তাহলে প্রশ্ন, শিশুকর্মী হ্যাপীকে নির্যাতন করেছে কারা, তাদের কি শাস্তি হবে না?
আসলে বিষয়টি অন্য৷ আর তা হলো মামলা প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ আদালতে হাজির করতে পারেনি পুলিশ৷ মামলার তদন্তেও ছিল ত্রুটি৷ এর সুবিধা পেয়েছে আসামিপক্ষ৷ আইনের ভাষায় ‘বেনিফিট অফ ডাউট' আসামিদের বাঁচিয়ে দিয়েছে৷ কারণ বাংলাদেশে ফৌজদারি মামলা সন্দেহাতীতভাবে সাক্ষী প্রমাণের ভিত্তিতে উপস্থাপন করতে হয়৷
এবার আরেকটি ঘটনা৷ ২০১৪ সালের আগস্টে ঢাকার জননিরাপত্তা আদালতের বিশেষ জেলা ও দায়রা জজ ফারুক আহম্মেদ অবসরের আগের ১৮ কার্যদিবসে ২৪ মামলার রায় দেন৷ এসব মামলার আসামিদের তিনি বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন৷ এছাড়া তিনি একদিনে ১০ মামলার সব সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ এবং যুক্তিতর্ক শেষ করেন৷ শুনানি শেষে চার থেকে দশ দিনের ব্যবধানে ২০টি মামলার নিষ্পত্তি করেন৷
মামলা খালাসের পাশাপাশি বিচারক ফারুক আহম্মেদ ঐ বছরের জুন মাসেই দাগী আসামিসহ ৪৫ জন আসামিকে জামিন দিয়েছেন৷ ছয় মাসেই খালাস দিয়েছেন ৭৭ মামলার আসামিদের৷ এছাড়া জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে ১০১ জন আসামিকে জামিন দিয়েছেন৷ ২০১৩ সালে ৭৯টি মামলার নিষ্পত্তি করেছেন৷ এর মধ্যে ৬০ মামলার আসামিকে খালাস ও ১৯ মামলার আসামিদের সাজা দেন তিনি৷
এই ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয় এবং তাঁর দেয়া মামলার নথিপত্র জব্দ করা হয়৷ দুর্নীতি দমন কমিশন তাঁর অবৈধ সম্পদের তদন্ত করছে৷
অভিযোগ প্রমাণে পুলিশের ব্যর্থতার খতিয়ান
পুলিশ সদরদপ্তরের এক হিসেবে দেখা যায়, পুলিশ অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় ৭৬ শতাংশ মামলার ক্ষেত্রে আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে৷ বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৫০০ ফৌজদারি মামলা হয়৷ সিআইডির প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ২০১১ সালে সারা দেশে বিভিন্ন মামলায় ২৪ শতাংশ অপরাধীর সাজা হয়েছে৷ ৭৬ শতাংশ মামলার ক্ষেত্রে আসামির বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি৷ তবে ২০০৯ সালে সাজার হার ছিল ২৩ শতাংশ৷ এ সময় পুলিশ তদন্ত করে ৪১ শতাংশ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে৷ বাকি মামলার আসামিরা তদন্ত পর্যায়েই অব্যাহতি পেয়েছে৷
অপহরণ মামলার ক্ষেত্রে এই চিত্র আরো ভয়াবহ৷ দেখা গেছে, গত ২৫ বছরে নিষ্পত্তি হওয়া ২১২ অপহরণ মামলার মধ্যে ১৯০ মামলাতে খালাস পেয়েছে আসামিরা৷ সাজা হয়েছে মাত্র ২১ মামলায়৷ ৯০ শতাংশ আসামিই এসব মামলায় খালাস পেয়েছে৷ এসব মামলায় ২,১০৩ জন আসামি ধরা পড়লেও দুই হাজার আসামিই জামিনে বেরিয়ে যায়৷ আর গত ১২ বছরে সারা দেশে দায়ের করা ২৭,০৮০টি অপহরণ মামলা হয়েছে৷ ঢাকার আদালতগুলোতে বিচারাধীন ২,৩৭৯টি অপহরণ মামলার মধ্যে ১২ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ৬১২টি মামলার বিচার কাজ৷
নির্যাতনের শিকার ২২,৩৮৬ জন, শাস্তি পেয়েছেন ১০১
গত বছরের মে মাসে একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়৷ তাদের অধীনে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের' আওতায় ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, খুলনা, সিলেট, রংপুর ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯ বছরে ২২,৩৮৬ জন নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনায় চিকিৎসা নেন৷ এই ঘটনাগুলোর বিচারিক প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে এ সব ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৫,০০৩টি৷ রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের৷ শতকরা হিসাবে রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার ০.৪৫ শতাংশ৷ আর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোতে গড়ে মাত্র শতকরা চারভাগ অপরাধী শাস্তি পায়৷
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, জানুয়ারি ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত নারী-শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর আওতায় ২,০৯৫টি মামলায় নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৭৪টি৷ নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় আসামি ছিলেন ৪১০ জন৷ সাজা ২৭ জন পেলেও ৩৮০ জনই খালাস পেয়ে যান৷ এরমধ্যে প্রতারণা এবং ধর্ষণ মামলা বেশি৷
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, গত ১৫ বছরে তাদের মামলায় দুই-তৃতীয়াংশ আসামি খালাস পেয়েছে৷ ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৩৫,০১০ জন আসামি খালাস পায়৷ আর সাজা পেয়েছে ১৮ হাজার আসামি৷
দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলারও একই অবস্থা৷ অধিকাংশ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে যান৷ চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১২৫টি মামলার মধ্যে ৬৬ মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছেন৷ ২০১৫ সালে ৩০৬ মামলার ২০৭টিতেই আসামিরা খালাস পান৷
এসব পরিসংখ্যানের ভিত্তি দায়ের করা মামলা৷ কিন্তু এখন অনেক ঘটনা আছে যেখানে মামলা দায়ের করাই অসম্ভব৷ আর মামলা হলেও আসামিরা ধরাই পড়েনা বা তাদের ধরা হয় না৷ গত ১৮ অক্টোবর ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ৬৫ বছর বয়সের মুক্তিযোদ্ধা এবং সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তার আহমেদ মৃধা ও তাঁর ছেলেকে নির্মম নির্যাতন চালায় আওয়ামী লীগেরই আরেকটি প্রভাবশালী গ্রুপ৷
এই ঘটনায় উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও যুবলীগের সভাপতি, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ১০ জনকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করা হয়৷ কিন্তু তাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি৷ উল্টো তারা আদালত থেকে জামিন নিয়ে হুমকি দিচ্ছে৷ তবে নির্যাতনের সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর এখন পুলিশ কিছুটা সক্রিয় হয়েছে৷
বিচারহীনতার কারণ
উপরের যে তথ্য-উপাত্ত তাতে বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রধান কারণগুলো হলো –
১. রাজনৈতিক এবং ক্ষমতার প্রভাব
২. দুর্নীতি
৩. মামলার তদন্তে অদক্ষতা
৪. অপরাধ দমন, তদন্ত এবং বিচারিক প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত জনবলের অভাব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান ঢাকার পাঁচটি আদালতের এক বছরে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার ওপর জরিপ করেছেন৷ তাতে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ শতকরা ১৫ থেকে ১৬ ভাগ মামলায় অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছে৷ আর ঐ তথ্যের সঙ্গে তিনি পুলিশ সদরদপ্তর থেকে তথ্য নিয়েও মিলিয়ে দেখেছেন৷ তাতেও ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তির হার একই রকম৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘মামলার তদন্তে দক্ষতার অভাবই বিচার না পাওয়ার প্রধান কারণ৷ আদালতে মামলা প্রমাণ করতে হলে মামলাটি প্রমাণ করতে হয় সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে৷ তাই তদন্তে যখন দুর্বলতা থাকে তখন সেটাই প্রধান গলদ৷'' তবে এর বাইরে দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতার প্রভাব কারণ হিসেবে কাজ করে৷ কিন্তু তদন্তের এটিই প্রধান কারণ৷ তিনি বলেন, ‘‘দক্ষ এবং পর্যাপ্ত জনবলসহ তদন্ত এবং বিচারব্যবস্থা ঢেলে সাজানো ছাড়া এ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই৷''
বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সঠিক তদন্তই হলো প্রথম কথা৷ এরপর সাক্ষী৷ অনেক মামলায় শেষ পর্যন্ত সাক্ষী পাওয়া যায় না৷ এর দু'টি কারণ: প্রথমত, অনেক সময় প্রভাবশালী বা সন্ত্রাসীদের ভয়ে সাক্ষীরা আসেন না৷ দ্বিতীয়ত, সাক্ষীদের টাকার বিনিময়ে কিনে নেয়া হয়৷'' তিনি বলেন, ‘‘জনবল, অবকাঠামোর অভাব আছে৷ কিন্তু সেই সবের আগে সাক্ষীদের সুরক্ষা দিয়ে তাদের আদালতে আনতে হবে৷ আর প্রভাবমুক্ত এবং দক্ষ তদন্ত সংস্থা গড়ে তুলতে হবে৷''
তাঁর মতে, ‘‘দুর্নীতি আছে, কিছু রাজনৈতিক প্রভাব আছে৷ তবে বিচার বিভাগ এখন আর প্রশাসনের অধীনে নয়, তারা স্বাধীন৷'' তিনি বলেন, ‘‘বিচারহীনতা অবশ্যই অপরাধ বাড়ায়, অপরাধীকে বেপরোয়া করে৷ এই সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে৷''
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷