মিশরে যৌন নিপীড়ন
১৬ আগস্ট ২০১২সাখারভ পুরস্কার জয়ী আসমা মাহফুজ
‘‘সবাই শোনো, তাহরির স্কয়ারে চললাম আমি৷'' রাগ-ক্ষোভ চাপতে না পেরে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ফেসবুকে এই শব্দগুলো লিখে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন আসমা মাহফুজ৷ ২৫শে জানুয়ারি ২০১১'র এক সপ্তাহ আগে তাঁর এই লেখাটি ছিল বারুদের স্তূপে স্ফুলিঙ্গ৷
সেই লেখা এবং ভিডিও'তে মোবারক হটাও বিক্ষোভে জ্বলে ওঠে মিশর৷ আসমা'র কথা চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে ১৭ থেকে ৩০ বছর বয়সিদের৷ একে একে তাঁরা জমা হয় বিভোক্ষের কেন্দ্রস্থল তাহরির স্কয়ার'এ৷ এর পরের ঘটনা সবার জানা৷ কায়রোর সেই ‘লিবেরেশন স্কয়ার' প্রত্যক্ষ করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে লাখো মানুষের মিছিল, সংঘর্ষ, তিনশো মানুষের প্রাণহানি আর রক্তপাত৷
আসমা মাহফুজ'কে আমরা এ যুগের ‘হ্যামিলনের বংশীবাদক' বলবো কিনা – তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু সে'দিনের সেই তাহরির স্কয়ার'এর সঙ্গে আজকের তাহরির স্কয়ার'এর যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য – তা নিয়ে সম্পূর্ণভাবে একমত মিশরের তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে মেয়েরা৷
শ্লীলতাহানির শিকার নিহাল সাদ জাগলুল
তাদেরই একজন নিহাল সাদ জাগলুল৷ ঘুমের মধ্যে আজও নিহাল ছটফট করে গত জুন মাসের সেই ঘটনার কথা মনে করে৷ তার কথায়, ‘‘ঘটনাটা একটা শুক্রবারের৷ আমি বন্ধুদের সঙ্গে একটা প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিতে তাহরির স্কয়ার'এ গিয়েছিলাম৷ হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ভিড়ের মধ্যে আমি বন্ধুদের থেকে ছিটকে পড়েছি৷ আর প্রায় ১৫ জন পুরুষ আমাকে চার দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে৷ কেউ আমার হিজাব ধরে টানছে, কেউ বা পেছন থেকে চেপে ধরছে৷ এত ভয় আমি জীবনে কখনও পাই নি৷''
এরপরেও নিহাল'কে ভাগ্যবতীই বলতে হবে৷ কারণ সেদিন তার চিৎকার শুনে এগিয়ে এসেছিল বহু মানুষ৷ উদ্ধার করেছিল তাকে৷ কিন্তু কায়রোর এই শহরতলিতে চারদিক থেকে এগিয়ে আসা হাতের থাবাগুলো মেয়েদের পরনের কাপড়টিকে ছিন্নভিন্ন করেই ক্ষান্ত থাকে না, তাকে উলঙ্গ করে শরীরটাকে দুমড়ে-মুচড়ে একাকার করে৷ এমনকি অনেককেই এভাবে শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের শিকার হতে হয়৷
মেয়েদের আত্মসম্মানকে গুড়িয়ে দিতে চায় পুরুষ
কিন্তু কেন? মিশরে জাতিসংঘের নারী বিষয়ক প্রকল্পের প্রতিনিধি স্যালি জোহনে জানান, ‘‘এধরনের ঘটনার একটা প্রধান কারণ অবশ্যই রাজনৈতিক৷ রাস্তাঘাটে মেয়েদের যে ধরনের মানহানি ঘটে, তার থেকে এগুলো আলাদা৷ মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া, শরীরের বিশেষ অংশে হাতের আঙুল ঢোকানো – এ'সবই তাদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ থেকে, তাহরির স্কয়ার থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র৷''
তবে সব ধরনের ব্যভিচারের কারণই রাজনৈতিক নয়, বলেন তিনি৷ অনেক ক্ষেত্রেই ভিড়ের মধ্যে নিজেদের স্বার্থ ও যৌন লালসা চরিতার্থ করতে চায় পুরুষনামক এই ঘৃণ্য জীবেরা৷ ২০০৬ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, কায়রোর রাস্তায় দৈনিক প্রায় ৮০ শতাংশ নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়৷ আর সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এহেন আচরণের পরেও পার পেয়ে যায় ভক্ষকরা৷
‘আমরা শুধু মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাই'
স্যালি বলেন, ‘‘মিশরের পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় রাজপথে নারীর যেন কোনো স্থান নেই৷ যারা মেয়েদের ওপর অত্যাচার করে চলেছে, তাদের শাস্তি দেওয়ার না আছে কোনো আইনি ব্যবস্থা, না আছে অন্য কোনো উপায়৷ তাই পরিবর্তিত এই রাজনৈতিক পরিবেশ আমাদের জন্য আনন্দ নিয়ে এলেও, এর জন্য মেয়েদের মাশুল দিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত৷''
তাই মিশরে গণতন্ত্র কায়েম হলেও তার সুযোগ যে কট্টরপন্থিরা নেবেই, তা বলাই বাহুল্য৷ এরপরেও নিহাল সাদ জাগলুল'এর ভাষায়, ‘‘আমাদের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না৷ মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিয়ে আমরা ভীত নই৷ আমি শুধু সমানাধিকার চাই৷ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার চাই আমি৷''
প্রতিবেদন: ভিক্টোরিয়া ক্লেবার, দেবারতি গুহ
সম্পাদনা: আরাফাতুল ইসলাম