রাজনীতি ও বিচার ব্যবস্থা: মৃত ব্যক্তিও সাজা পেলেন
৮ ডিসেম্বর ২০২৩তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক কারণে কোনো মামলার রায় হচ্ছে না- যা হচ্ছে তা আইনি প্রক্রিয়া মেনে হচ্ছে৷
দেশে লাখ লাখ মামলা জট থাকলেও বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে৷
সাড়ে তিন মাসে বিএনপির ৮১৪ নেতা-কর্মীর সাজা
একইদিনে বিএনপির ৩০-৪০ জন নেতা-কর্মীর বিভিন্ন মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হচ্ছে৷ এই মামলাগুলোর অধিকাংশরই বাদী পুলিশ৷ মামলাগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে ভাঙচুর, আগুন, নাশকতা ও পুলিশের ওপর হামলার মামলা৷ গত সাড়ে তিন মাসে মোট ৫২টি মামলায় বিএনপির ৮১৪ জন নেতা-কর্মীর বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে৷
বুধবারও (৬ ডিসেম্বর) তিনটি মামলায় বিএনপির ৪৬ জন নেতা-কর্মীকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ যে তিনটি মামলায় সাজা হয়েছে তা ২০১৮ সালের মামলা৷
একটি মামলা ২০১৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ক্যান্টনমেন্ট থানায় দায়ের করা৷ ওই মামলার বাদী পুলিশ৷ মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ভাঙচুর ও পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ছোড়া হয়৷ এতে চার পুলিশ সদস্য আহত হন৷
২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর কোতয়ালী থানায় পুলিশের দায়ের করা আরেকটি মামলায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে যানবাহন ভাঙচুর এবং পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ করা হয়৷ ওই সময়ে দুইজন পুলিশ সদস্য আহত হন৷
স্থগিতাদেশ থাকার পরও রায় দেওয়ার অভিযোগ
গত ৪ ডিসেম্বর বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের ১৫ জন নেতা-কর্মীকে ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর সবুজবাগ থানায় দায়ের করা একটি মামলায় তিন বছর ছয়মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়৷ মামলার আইনজীবীদের অভিযোগ, ওই মামলাটির কার্যক্রম হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত থাকার পরও তা উপেক্ষা করে মামলার রায় দেওয়া হয়৷
এই মামলার আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মাসুদ মো. মাসুদ রানা বলেন, ‘‘বিএনপির মিছিল, সমাবেশকে কেন্দ্র করে ২০১২ সালে সবুজবাগ থানায় মামলাটি হয়৷ ১৫ জনকে আসামি করা হয়৷ ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি হাইকোর্ট এই মামলার সকল কার্যক্রম স্থগিত করেন এবং রুল দেন৷ এখনো সেই অবস্থায় আছে৷ বিচার আদালতে হাইকোর্টের আদেশের সার্টিফায়েড কপিও দেয়া হয়েছে৷ রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী কিছুদিন আগে বললেন বিএনপির বিরুদ্ধে সকল মামলার রায় দিতে হবে৷ তারপর আদালত সাক্ষী তলব করে মামলার রায় দেয়৷ ১৫ জনকে সাড়ে তিন বছর করে কারাদণ্ড দেয়৷ যা বেআইনি এবং অন্যায়৷''
তিনি বলেন, ‘‘শুধু বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার রায় দিতে হবে এই একটি মানসিকতা নিম্ন আদালতের বিচারকদের মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে৷ এটি একটি রাজনৈতিক মামলা৷ বিচারক হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন৷ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং রায় প্রত্যাহার করা উচিত৷ আমরা এটা নিয়ে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেব৷''
মৃত ব্যক্তির সাজা!
মৃত ব্যক্তিকে দণ্ড বা মামলার আসামি করার একাধিক নজির আছে৷ নজির আছে গায়েবি মামলার৷ গত ৩ নভেম্বর গাজীপুরের কাপাসিয়ায় একটি নাশকতার মামলায় এক মৃত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়৷ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির ওই মামলায় স্থানীয় বিএনপির ২২ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়৷ তার মধ্যে ১৮ নাম্বার আসামি করা হয়েছে মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন মোল্লাকে৷ বয়স লেখা হয়েছে ৪৫ বছর৷ তিনি আসলে ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি মারা গেছেন৷
একইভাবে ২৪ জুলাই ঢাকার মিরপুরের বাংলা কলেজ এলাকায় ভাঙচুরের মামলার আসামিদের মধ্যে দুই জন বিএনপি নেতা শফিকুল ইসলাম ও আব্দুল জব্বার৷ আব্দুল জব্বার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২০২১ সালের ১১ অক্টোবর৷ আর শফিকুল ইসলামও ঘটনার ৯ মাস আগে মারা যান৷
এদিকে ২৩ ও ২৯ নভেম্বর বিএনপির দুই মৃত ব্যক্তিকে সাজা দিয়েছেন আদালত৷ সবুজবাগ থানায় ২০১২ সালে করা এক মামলায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ১৫ নেতাকর্মীকে ২৯ নভেম্বর দুই বছর ৬ মাস কারাদণ্ড দেন আদালত৷ এরমধ্যে ২০২১ সালের ১৩ জুলাই মারা যাওয়া ৭৩নং ওয়ার্ড বিএনপির নেতা সোহরাওয়ার্দী চেয়ারম্যানকেও সাজা দেয়া হয়েছে৷
আর ২০১৭ সালে করা পল্টন থানার এক মামলায় ২৩ নভেম্বর বিএনপির ৩৬ নেতাকর্মীকে চার বছরের কারাদণ্ড ও প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ১৭ দিন কারাদণ্ড দেওয়া হয়৷ এর মধ্যে রায়ের আদেশে উল্লিখিত ১২ নাম্বার আসামি তানভীর আদিল খান বাবু মারা গেছেন বলে জানান তার আইনজীবী আবু বক্কর৷
‘আগে এরকম দেখিনি'
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘আদালতকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মানুষ কথা বলছে৷ এটা তো এমনিতেই বলছেন না৷ হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে দ্রুত কিছু মামলার রায় হয়ে যাচ্ছে৷ ওই মামলাগুলোর আসামি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা৷ আবার কেউ বার বার জামিন চেয়েও পাচ্ছে না৷ কিন্তু কেউ আবার অল্প সময়ের মধ্যে জামিন পেয়ে দল পরিবর্তন করে নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন৷ ফলে আদালতকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কথা উঠছে৷ আগে আমরা এরকম দেখিনি৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আইনে রাজনৈতিক মামলা বলে কিছু নেই৷ তবে রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কোনো ভাঙচুর বা পুলিশের সঙ্গে মারামারি- এসব ঘটনা ঘটে৷ এই ঘটনায় মামলা হলে সেখানে রাজনৈতিক উপাদান থাকে বলে আমরা রাজনৈতিক মামলা বলি৷ রাজনৈতিক মামলা আজকের নয়৷ বহু বছর ধরেই হচ্ছে৷ এইসব মামলায় আসলে শেষ পর্যন্ত কিছু হয় না৷ এরশাদ ও বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেক রাজনৈতিক মামলা হয়েছে৷ ওইসব মামলায় তো আমরা তেমন কিছু হতে দেখিনি৷ এখন হঠাৎ করে শাস্তি শুরু হওয়ার কারণে এটা নিয়ে কথা হচ্ছে৷''
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) গত ২৬ নভেম্বর বলেছে, ‘‘সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রতিযোগিতা দূর করতে বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক ও সহিংস দমন-পীড়ন শুরু হয়েছে এবং ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশের দিন থেকে এপর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ গ্রেপ্তার হওয়া অধিকাংশই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতাকর্মী৷ তাদের একটি বড় অংশের বিরুদ্ধে বিচারিক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে৷'' বিএনপির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এইচআরডাব্লিউ জানায়, দলটির প্রায় ৫০ লাখ সদস্যের অর্ধেকই বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিচারের সম্মুখীন৷
রাজনৈতিক বিবেচনায় কাজ
বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘‘আদালতকে যে এই সরকার রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে তা নানা ঘটনায় স্পষ্ট৷ এটা শুধু আমরা বলছি না আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বলছে৷ হঠাৎ করে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা পুরনো মামলায় দণ্ড দেওয়া শুরু হয়েছে গত তিন-সাড়ে তিন মাস ধরে৷ যে মামলায় ৫০ জন সাক্ষী আছে সেই মামলায় চারজনের সাক্ষ্য নিয়ে রায় দিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ ফৌজদারি মামলার বিধান মতে আসামিদের এবং সাক্ষীদের কোনো সমন দেয়া হচ্ছে না৷ পলাতক থাকলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে না৷''
তার কথা, ‘‘মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে৷ আবার সেই মৃত ব্যক্তিকে শাস্তিও দেওয়া হচ্ছে৷ হাইকোর্ট মামলার কার্যক্রম স্থগিত করার পরও সেই মামলায় শাস্তি দিচ্ছে বিচার আদালত৷ তারা কোনো বিচারিক নিয়ম-নীতি অনুসরণ করছেন বলে মনে হচ্ছে না৷ তারা কাজ করছেন রাজনৈতিক বিবেচনায়৷''
‘এখন সাক্ষীদের রিয়েলাইজেশন হয়েছে যে সাক্ষ্য দেয়া প্রয়োজন'
তবে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আবু এই সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘কোনো রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলার রায় হচ্ছে না৷ এই সব মামলা অনেক পুরনো৷ দীর্ঘদিন ধরেই মামলার বিচারকাজ চলছিল৷ সাক্ষ্য নেয়া হচ্ছিল৷ ধারাবাহিক প্রক্রিয়াই মামলার রায় হচ্ছে৷''
হঠাৎ করে একের পর এক রায় কেন হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এতদিন সাক্ষীরা আসেনি৷ এখন সাক্ষীদের মধ্যে রিয়েলাইজেশন হয়েছে যে সাক্ষ্য দেয়া প্রয়োজন তাই তারা আদালতে সাক্ষী দিতে আসছেন৷ মামলার রায় হচ্ছে৷ আমরা তো আর সাক্ষীদের ফিরিয়ে দিতে পারি না৷ আর যাদের বিরুদ্ধে রায় হচ্ছে তাদের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তো রায় হচ্ছে৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘কোনো আসামি মারা গেলে তা তো আসামি পক্ষকে আদালতে জানাতে হবে৷ পুলিশও জানাতে পারে৷ না জানালে বিচারক জানবেন কীভাবে? এখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় হয়নি৷ আর উচ্চ আদালত কোনো মামলার বিচার স্থগিত করলে বিচার আদালতে তার রায় হতে পারে না৷ কিন্তু সেটাও তো আসামি পক্ষকে আদালতে জানাতে হবে৷ তারা জানায়নি৷ এটা আসামি পক্ষের দায়৷''