রাজনৈতিক আন্দোলনে হরতাল-অবরোধ-ঘেরাও
৪ আগস্ট ২০২৩বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে তার পর আর কোনো আন্দোলনের তুলনা চলে না। কিন্তু এরপরও বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলন। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির আন্দোলন। ২০০৭ সালে বিএনপির শাসনামলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আন্দোলন।
২০১৩—১৪ সালে বিএনপির নির্বাচন বর্জন আন্দোলনও আলোচনায় আছে। আর এখন চলছে বিএনপির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। প্রায় ৯ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তাকে গণঅভ্যুত্থানের মুখে বিদায় নিয়ে কারাগারে যেতে হয়। এরশাদের পতনের মূলে ছিল সব মেরুর রাজনৈতিক দলের এরশাদবিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। এরশাদবিরোধী আন্দোলের শেষ সপ্তাহে সারাদেশে ৭০ জনের মতো নিহত হন।
ওই সময় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন ছিল এক বড় ঘটনা। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনের পর আন্দোলন সবচেয়ে বেশি গতি পায়। তখন সব রাজনৈতিক দল যৌথভাবে কর্মসূচি দিতো। সেই সময়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সভাপতি এবং এখন বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, "এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ছিল সব দলের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। আর ওই আন্দোলনের হাতিয়ার ছিল হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও। সমাবেশ মিছিল তো ছিলই। টানা ৭২ ঘণ্টা, ৯৬ ঘণ্টা, ১২০ ঘণ্টা হরতালও হয়েছে। আমরা সচিবালয় ঘেরাও করেছি।”
"পুলিশ তখনো হামলা করেছে। পুলিশের গুলিতে অনেকে নিহত হয়েছেন। কিন্তু এখনকার মতো এত মামলা হয়নি। আর পুলিশের অনুমতি নিয়ে আমরা কোনো আন্দোলন করিনি। পুলিশের অনুমতি নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন হয় না,” বলেন সাবেক এই ছাত্র নেতা। ডাকসুর সাবেক ভিপি এবং নাগরিক ঐক্যের প্রধান মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, "এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে এখনকার আন্দোলনের বড় পার্থক্য হলো, এরশাদের দল জাতীয় পার্টির কোনো শক্ত গণভিত্তি ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগ দল হিসেবে অনেক পুরোনো এবং তার সংগঠন অনেক শক্তিশালী। আওয়ামী লীগ নিজেও সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছে। আবার আন্দোলনে কীভাবে ভাঙন ধরাতে হয় তা-ও জানে।” ২০০৭ সাল সালের আন্দোলনে হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও, সহিংসতা ছিল। হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন আওয়ামী লীগ তো ১৯৯৬ সালের আন্দোলনে ১৭২ দিন হরতাল করেছে।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ ছেড়ে দেন। ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন।
নির্বাচন হয় ২০০৮ সালের ২৯ জানুয়ারি। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা ২৬২ আসনে জয়ী হয়। বিএনপির নেতৃত্বে চার দল পায় ৩২টি আসন। এরপর থেকে টানা তিন টার্মে প্রায় ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে। তার আগে আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিদায় করে আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচনে বিএনপি ও তাদের সমমনারা অংশ নেয়নি। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ২০১৩—১৪ সালে আন্দোলন করে এবং নির্বাচন প্রতিহত করার ডাক দেয়। এই আন্দোলনে ব্যাপক সহিংসতা হয়। গাড়ি পোড়ানো হয়। পেট্রোল বোমায় নিহত ও আহতের সংখ্যা ছিল অনেক। তাদের আন্দোলনের শেষ দুই মাসে ১২১ জন নিহত হন। বিএনপির এই আন্দোলনকে আওয়ামী লীগ অভিহিত করে "আগুন সন্ত্রাস” হিসেবে।
আর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ‘লগি-বৈঠার' আন্দোলনকে বিএনপি অভিহিত করে ‘লগি বৈঠা দিয়ে মানুষ পিটিয়ে মারার আন্দোলন' হিসেবে। ওই বছরের ২৮ অক্টোবর এক সময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বিচারপতি কে এম হাসানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর সমাবেশে সবাইকে লগি-বৈঠা নিয়ে হাজির হতে বলেছিল। ওই দিন পুলিশের বাধার মুখে পুরো ঢাকা শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। ওই দিন ঢাকায় ১২ জন নিহত হন। কে এম হাসান নিজেই শপথ নিতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন। পরে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে ইয়াজউদ্দিনকেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ ছাড়তে হয়। আসে ওয়ান ইলেভেন। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় দুই বড় দলের অনেক নেতাকে। ড. ফরাস উদ্দিনের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার টু মাইনাস থিওরি নিয়ে এগোতে চেয়েছিল। তারা এক বছর ক্ষমতায় ছিল। তারাও আন্দোলনের মুখে দুই নেত্রীকে মুক্তি এবং নির্বাচন দিতে বাধ্য হন।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, "মুক্তিযুদ্ধের আগে দেশে যত আন্দোলন হয়েছে তাতে পুরো জাতি ছিল ঐক্যবদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ওই সব আন্দোলনে আদর্শিক দিক ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ছিল বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার আন্দোলন। ছাত্র জনতার উত্তাল স্রোত। শত্রু ছিল সুনির্দিষ্ট।”
"এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনেও সব রাজনৈতিক দল এক হয়েছিলো। ফলে হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও এই কর্মসূচিগুলো ফল দিয়েছে। আন্দোলন করতে গিয়ে অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। আন্দোলন সফল হয়েছে। কিন্তু এখন দেশের মানুষের মধ্যে বিভক্তি আছে। এখানে নানা বিষয় নিয়ে মানুষও বিভক্ত। এখানে স্বাধীনতা পক্ষ বিপক্ষ আছে। ফলে ওইভাবে আন্দোলন করা কঠিন। সাধারণ মানুষ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়না। ঢাকা শহরে হরতাল, অবরোধ কার্যকর করা কঠিন। এটা হয়তো আর সম্ভব নয়। কারণ, মানুষ বেড়েছে। শহর বিস্তৃত হয়েছে, ”বলেন মুনতাসীর মামুন। তার কথা, "এখন বিরোধীরা নানা কর্মসূচি দিয়ে যেমন রাস্তা দখল করে মানুষের অসুবিধা করছে। যারা সরকারে আছে তারাও একই কাজ করছে।”
এরশাদের পতনের পর মাত্র চার বছরের মাথায় আওয়ামী লীগ বড়আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের ওই আন্দোলন সফল হয়। বিএনপির মিত্র ও জামায়াতে ইসলামীও তখন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উপেক্ষা করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একতরফা নির্বাচন করে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত সহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচন বর্জন করে। ওই নির্বাচনের পর সংসদ মাত্র ১২ দিন স্থায়ী ছিলো। আওয়ামী লীগ তীব্র আন্দোলন ছাড়াও জনতার মঞ্চ তৈরি করেছিল।
সেই মঞ্চে প্রশাসনের কর্মকর্তারাও যোগ দেন। আওয়ামী লীগের হরতাল, অবরোধ আর অসহযোগ আন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সংসদ ভেঙে দেয়া হয়। তার আগেই ১২ দিনের সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয়। বিচারপতি হাবিবুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন।
মাহমুদুর রহমান মান্না মনে করেন, "আওয়ামী লীগের ওই সময়ের আন্দোলন সফল হওয়ার মূল কারণ তারা প্রশাসনকে তাদের সঙ্গে আনতে পেরেছিলো। জনতার মঞ্চে তারা যোগ দিয়েছিলেন।”
তার কথা, "হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও সবসময়ই আন্দোলনের প্রধান অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। তবে এতে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি মনে করি হরতাল এখনো রাজনৈতিক আন্দোলনের ভালো একটি টুল। এর মাধ্যমে কম ক্ষতি করে মানুষকে সম্পৃক্ত করা যায়।”
বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে প্রতিহতের ডাক দিলেও ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নেয়। ওই নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ছয়টি আসন পায়। য সবাইকে বিস্মিত করে। বিএনপি ওই নির্বাচনকে রাতের ভোট অভিহিত করে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন শুরু করে, বলে সংসদে যাবেনা। যদিও শেষ পর্যন্ত মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া বাকিরা শপথ নিয়ে সংসদে যান। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপির সংসদ সদস্যরা ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন।
এর ২৮ বছর আগে ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ বিএনপির শাসনামলে মাগুরা—২ আসনের উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে পদত্যাগপত্র জমা দেন আওয়ামী লীগসহ বিরোধী ১৪৭ জন সংসদ সদস্য। যদিও তখন সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়নি।
বিএনপি এখন এক দফা দাবিতে আন্দোলনে আছে। তারা চায় সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। আর আওয়ামী লীগ সরকার অনঢ় আছে তাদের অধীনেই নির্বাচনের ব্যাপরে। মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, "আন্দোলনের কৌশল নিয়ে এখনো অস্বচ্ছতা আছে। আমরাও যুগপৎ আন্দোলনে আছি। কিন্তু কর্মসূচি বিএনপি এককভাবে ঠিক করছে। আর এটা এরশাদ সরকার নয়। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। কারণ আওয়ামী লীগ একটি পুরনো এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক দল।”
তার কথায়, "এখন আন্দোলনে গুনগত পরিবর্তন এসেছে। মানুষকে সম্পৃক্ত করার কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে। সহিংসতা বা মানুষকে জিম্মি করে আন্দোলন হবেনা।”
তবে হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, "গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করা যায়। কিন্তু এই সরকার তো গণতান্ত্রিক নয়। তাই শেষ পর্যন্ত হরতাল অবরোধ, ঘেরাও কর্মসূচি দিতে হবে। এগুলো আন্দোলনের কার্যকর হাতিয়ার।”
তার কথায়, "আগের আন্দোলনে সরকারি দল একই সময়ে কর্মসূচি দিতনা। এবার দেয়া হচেছ। এই পরিবর্তন দেখছি।”
মুনতাসীর মামুন মনে করেন, "আন্দোলনে জনগণ সম্পৃক্ত হলে তা সফল হয়। আর পুলিশ সব সময়ই আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়।”
তার কথা, "এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সফল হয়েছে, কারণ, তার অবৈধতার ব্যাপারে সবাই একমত ছিল।”