রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে ‘অন্য’ বিজয় দিবস
১৬ ডিসেম্বর ২০২২দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে ব্যাতিক্রমী বা নতুন কিছু ছিল না৷ শোভাযাত্রা আর দুই-একটি আলোচনা সভায় সীমাবদ্ধ তারা৷ রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি ছিল আগের মতোই৷ প্যারেড গ্রাউন্ডে হয়েছে বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ৷
সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শুক্রবার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী৷ এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করেন৷
বিএনপির চেয়াপার্সন দুনীতির মামলায় দণ্ডিত, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রবাসে এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কারাগারে থাকায় দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করেন সিনিয়র নেতারা৷ জাতীয় পার্টির পক্ষে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু অন্যান্য নেতাদের নিয়ে শ্রদ্ধা জানান৷ রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের স্মৃতিসৌধে যাননি৷
সকালের এই কর্মসূচির বাইরে আওয়ামী লীগের আর কোনো বড় কর্মসূচি ছিল না৷ যেসব কর্মসূচি ছিল, তার মধ্যে ছিল দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন৷ তারা টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি ও ৩২ নাম্বারে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছে৷
অন্যদিকে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জনানোর বাইরে বিএনপির কর্মসূচির ছিল বিজয় মিছিল আর জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ও নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে বিজয় মিছিল৷
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে, গণসংহতি আন্দোলন জোনায়েদ সাকির গণ অধিকার পরিষদ নুরুল হক নূরের নেতৃত্বে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করে৷ গণফোরাম, গণতন্ত্র মঞ্চ, নাগরিক ঐক্যের পক্ষে ফুল দেয়া হলেও অনেক শীর্ষ নেতাকে দেখা যায়নি৷
তবে কোনো ইসলামী রজনৈতিক দল স্মৃতিসৌধে যায়নি, যায়নি জামায়াতে ইসলামী৷ বিজয় দিবস উপলক্ষে পতাকা র্যালি করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ৷ খেলাফত মজলিস বিকালে আলোচনা সভার আয়োজন করে৷
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি প্রধানত স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল৷ কয়েকটি দল অবশ্য দলীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করে৷
স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘‘বিএনপি ষড়ন্ত্রের রাজনীতি শুরু করেছে৷ তারা মুত্তিযুদ্ধের অর্জনকে নস্যাৎ করতে চায়৷ তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে পরাজিত করতে হবে৷’’ অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘‘বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলুণ্ঠিত করছে৷ মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন , যে চেতনায় দেশ স্বাধীন হয়েছে সেই গণতন্ত্র আজ ভুলুন্ঠিত৷’’
মুক্তিযোদ্ধা-বিশ্লেষকের চোখে
মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রথম প্রতিরোধে অংশ নেয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘‘এখন বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে রাজনৈতিক দলগুলো যে কর্মসূচি নেয়, তা দলীয় কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে৷ যে যার গুণ গায়৷ ওইসব কর্মসূচি দিয়ে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে পারে না৷ মুক্তিযুদ্ধকে যে যার স্বার্থে ব্যবহার করছে৷’’
তার কথা, ‘‘মুক্তিযোদ্ধারা এখন ভাগ হয়ে গেছেন৷ তারা আওয়ামী লীগে আছে, তারা বিএনপিতেও আছে৷ আর বিএনপির সাথে আছে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত৷ তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেয়!’’
তিনি বলেন, ‘‘বিজয় দিবসের রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোও যেন দায়সারা গোছের৷ পালন করতে হয় তাই যেন করে৷ ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হয় না৷ আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তারা হতাশ হচ্ছি৷’’
‘‘বিজয় দিবসের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আমরা সবচেয়ে বেশি আশা করি আওয়ামী লীগের কাছে৷ গত ১৫ বছর ধরে তারা ক্ষমতায়৷ এই সময়ে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে৷ কিন্তু আমরা গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনো পাইনি৷ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আরো জোর দেয়া দরকার৷ এখানে কাজ করা দরকার,’’ বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন৷ তার কথা, ‘‘বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে এই কাজগুলো ভালো করা যায়৷ রাজনৈতিক দলগুলো যদি সেভাবে কর্মসূচি নেয়, তাহলে তা কাজে আসবে৷ আজকে (বিজয় দিবস) যদি দেশব্যাপী একটি কর্মসূচি থাকতো গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে, তাহলে আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এটা নিয়ে একটা মেসেজ দিতে পারতাম৷’’
তার কথা, ‘‘বিএনপি তো একটা মিক্সার৷ তাই কৌশলগতভাবে এমন কর্মসূচি নিতে হবে যাতে সবাই শামিল হন৷’’
বড় দুই দলের ভাবনা
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মনে করে, বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচি আরো বিস্তৃত এবং সর্বব্যাপ্ত করার সুযোগ আছে, তা করা দরকার৷ কিন্তু বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘‘এখন মিছিল, সমাবেশ করতেও পুলিশের অনুমতি লাগে৷ তাই চাইলেও আমরা অনেক কিছু করতে পারছি না৷” তিনি মনে করেন, "মুক্তিযুদ্ধের ইতহাস বিকৃত করা হচ্ছে৷ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বারোয়ারি করা হচ্ছে৷ এটা বন্ধ করে সঠিক ইতিহাসের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু কোনো দিবসে নয়, সব সময়ে ছড়িয়ে দিতে হবে৷’’
এর জবাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘‘২৮ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে৷ স্বাধীনতাবিরোধীদের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানো হয়েছে৷ শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ১৫ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ হচ্ছে৷ সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা হচ্ছে৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছে৷ তবে আরো অনেক কাজ বাকি৷’’
তার মতে, ‘‘দিবসকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি আরো বিস্তৃত করা উচিত৷ তবে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এখনো সক্রিয়৷ তারা নানাভাবে এসব কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়৷ তাদের পরজিত করতে হবে৷’’