রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব মুক্তিযোদ্ধা শওকত আরা
১৫ জানুয়ারি ২০১১শওকত আরা খাতুনের জন্ম হাড়ুপুর গ্রামে৷ ১৯৫২ সালের পয়লা জুলাই৷ বাবা আহমেদ হোসেন পণ্ডিত ও মা পরিজান বেগমের ১১ ছেলেমেয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ শওকত আরা৷ বর্তমানে স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন পাবনা শহরের রাধানগরে৷ স্বামী মোহাম্মদ হোসেন জামাল পিটিআই ইনস্ট্রাকটর পদের চাকরি থেকে কিছুদিন আগে অবসরে গেছেন৷ শওকত আরা খাতুন কর্মরত পাবনার আতাইকুলা ডিগ্রি কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে৷
অসহযোগ আন্দোলন থেকে রাজশাহীতে শুরু হয় প্রতিরোধের প্রস্তুতি৷ রাজশাহী পুলিশ লাইন, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ক্যাম্প, আনসার ক্যম্পের স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন৷ স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেন রাজশাহী পুলিশ লাইনের স্বাধীনতাকামী বাঙালি সদস্যরা৷ পাশের গ্রাম কাঁঠালবাড়িয়া গ্রামে একটি নিমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে শওকত আরা দেখেন পাকিস্তানি সৈন্যরা যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে নারী পুরুষদের আলাদা করে লাইনে দাঁড় করাচ্ছে৷ জোর করে নারীদের তুলে নিচ্ছে তাদের গাড়িতে৷ পুরুষদের দড়ি দিয়ে বেঁধে গাড়িতে তুলে নির্যাতন করছে৷ এসব তাঁকে অস্থির করে তোলে৷ যুদ্ধের জন্য নিজেকে তৈরি করতে ছুটে যান নিজ গ্রামে৷ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করে শিখে নেনে গ্রেনেড এবং রাইফেল চালানো৷
দীর্ঘ নয়মাস মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন এই বীর নারী৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে টেলিফোন সংলাপে শওকত আরা বললেন, ‘‘একদিন পাক সেনাদের আসার খবর পেয়ে ফুপু বানু আমাকে, আমার ভাই শাখাওয়াত, আব্দুস সালাম ও অন্যান্যদের একটি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দরজায় বসে থাকলেন৷ পাকিস্তানি সৈন্যরা আমার চাচা গোলাম রব্বানী, আমানুল্লাহ, ড. শহিদুল্লাহ আজিজ, লেনিনকে ধরে লইনে দাঁড় করিয়ে আমিনকে জোর করে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগ সর্মথকদের খুঁজতে থাকলো৷ ফুপু বানুকে ঘরটি দেখিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা জিজ্ঞেস করলো ‘ভেতরে কে?' উনি সাহসের সাথে উত্তর দিলেন ‘জেনানা' অর্থাৎ নারী৷ পাকিস্তানি সৈন্যরা আর কিছু না বলে সেদিন বিদায় নিল৷ তবে লাইনে দাঁড় করানোদের ওপর নির্যাতন করতে থাকলো৷ ওই দিন বিকেলে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান থেকে গ্রামটির ওপর গুলি করা হয়৷
যাহোক, যুদ্ধে অংশ নিতে হলে তো শুধু গ্রামে বসে থাকলে চলবে না৷ তাই কিছুদিন পর গ্রাম থেকে আবারও রাজশাহী শহরে চলে আসেন শওকত আরা৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি তেমন নেই৷ ক্লাসও তেমন হচ্ছে না৷ এ সুযোগে প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে যান৷ সুযোগ বুঝে নিলেন সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং৷ এরপর শুরু করেন শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার কাজ৷ পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের চোখের সামনে দিয়ে অস্ত্র ভর্তি ট্রাঙ্ক আনা-নেওয়ার কাজ করেছেন তিনি৷
এই দুঃসাহসিক কাজের একদিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন ডয়চে ভেলের কাছে৷ তিনি বলেন, ‘‘ফুপাতো বোন হাসমত আরা হাসিকে সঙ্গে নিয়ে রাজশাহী থেকে ট্রেনে চব্বিশনগরে গিয়ে গণি নামে এক গ্রামবাসীর সহযোগিতায় তার বাড়ি থেকে গ্রেনেড সংগ্রহ করে, কৌশলে তা পরের দিন রাজশাহী শহরে এনে শেখ পাড়ায় মুক্তিযোদ্ধা মোনায়েম মঞ্জুরের বাড়িতে পৌঁছে দিলাম৷ চব্বিশনগর, কাকনহাট থেকে গ্রেনেড, অস্ত্র নিয়ে তা রাজশাহী শহরে আনা-নেওয়া করতে থাকি৷ ইতিমধ্যে ৭নং সেক্টরের সাব সেক্টর ৪'এর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নির্দেশ দিলেন রাজশাহী শহরের ঘোড়ামারায় কুঞ্জমৈত্রীর বাড়িতে রাজাকার ক্যাম্প, বোয়ালিয়া থানার পাশে মোসলেম আলীর বাড়িতে আল বদরদের ক্যাম্প, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, বিদ্যুৎ ভবনসহ কয়েটি স্থানে অপারেশনের৷ এই কাজে সহযোগিতা করার জন্য তখনকার বুয়েটের ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা বাবর আলী কথা বললেন আমার সাথে৷ কথা মতো ৭ অক্টোবর আমি বাবর আলীকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বস্ত রিকশা চালকের সহযোগিতায় চব্বিশ ইঞ্চি একটি ট্রাঙ্কে চারটি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন, বিস্ফোরক, এসএমজি, গ্রেনেড, কারবাইন ম্যাগজিন নিয়ে রাজশাহী কোর্টের পশ্চিম দিকে থেকে রওনা হই৷ রাজশাহী কোর্টের কাছে পাকিস্তানি সৈন্যরা জিজ্ঞাসা করলো ‘তোমরা কোথায় যাও?' বাবর আলী বললেন, ‘আমার বোন, তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে রাখতে যাচ্ছি'৷ এছাড়া পথে আরো কয়েকবার পাক সেনা ও গোয়েন্দাদের নজরে পড়ি আমরা৷ তবে শেষ পর্যন্ত রোমাঞ্চকর পথ পাড়ি দিয়ে ট্রাঙ্কটি পৌঁছে দেই মধ্য শহরের পাবলিক লাইব্রেরিতে অপেক্ষা করা লাইব্রেরিয়ান রেজাউল আহমেদ ও পিওন মজিবুর রহমানের কাছে৷ আর এসব অস্ত্র দিয়ে কয়েকদিন পরেই চালানো হয় বেশ কিছু অপারেশন৷ এভাবে অনেকবার অস্ত্র আনা-নেওয়ার কাজ করেছি আমরা৷''
এসব কাজের ফলে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের কাছে খবর পৌঁছে যায় শওকত আরার গোপন কর্মতৎপরতার৷ তাঁকে ধরতে উঠে পড়ে লেগে যায় পাক সেনারা৷ তবে তিনি বেশ কয়েকবার অল্পের জন্য বেঁচে যান পাক সেনাদের হাত থেকে৷ শেষ পর্যন্ত অক্টোবরের শেষ দিকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতের আঁধারে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মুর্শিদাবাদ যান তিনি৷ ভারতে গিয়ে নেমে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানা কাজে৷ পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে অস্ত্র সংগ্রহ করেন৷ সেসব অস্ত্র পাঠান মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে৷ লিফলেট বিলিসহ নানাভাবে জনমত তৈরির কাজ করেন তিনি৷ ১৮ ডিসেম্বর শত্রু মুক্ত হয় রাজশাহী৷ তখন মুক্ত-স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন এই মহিয়সী নারী৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ