রাম তুমি কার, নেপাল না ভারতের
১৪ জুলাই ২০২০ভারতের রাজনৈতিক আবর্তে রামচন্দ্রকে নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। পৌরাণিক এই চরিত্রকে নিয়ে ভারতের মূলস্রোতের রাজনীতিতে বহু উত্থানপতন ঘটেছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছে। এবং পরবর্তীকালে আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে মামলা। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেও সেই বিতর্ক সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়নি। কিন্তু নেপালের কমিউনিস্ট প্রধানমন্ত্রী সেই বিতর্ককে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিলেন। দাবি করলেন, রাম নেপালি ছিলেন। তাঁর জন্মস্থানও নেপালেই, ভারতে নয়।
সোমবার নিজের বাসভবনে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্ম ওলি। সেখানেই তিনি দাবি করেন, রামজন্মভূমি হিসেবে যে অযোধ্যার কথা বলা হয়, তা আসলে ভারতে নয়, নেপালে। রাজধানী কাঠমাণ্ডু থেকে ১৩৫ কিলোমিটার দূরে বীরগঞ্জের কাছে অযোধ্যা বলে একটি জায়গা আছে। এরপরেই রামকে নেপালি বলে দাবি করেন তিনি। এখানেই থেমে থাকেননি ওলি। তাঁর অভিযোগ, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি সমস্ত ক্ষেত্রেই ভারত নেপালের উপর দাদাগিরি করে। সে কারণেই নেপালের সংস্কৃতিকেও নিজের বলে দাবি করে। ওলির স্পষ্ট বক্তব্য, নেপালের ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে।
দীর্ঘ দিন ধরে নেপালের সঙ্গে অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ভারতের। নেপালের বহু বিষয়ে ভারত সরাসরি সাহায্য করে। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে সেই নেপালের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ত হয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভারত নেপাল সীমান্তে একটি রাস্তা উদ্বোধনের পর। নেপালের প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন, ভারত যে রাস্তা বানিয়েছে তা নেপালের ভূখণ্ডে ঢুকে গিয়েছে। এরপরেই রাতারাতি নেপালের সংসদে দেশের মানচিত্র সংক্রান্ত একটি বিল পাশ করান ওলি। সেখানে ভারত-নেপাল সীমান্তের তিনটি জায়গাকে নেপাল নিজেদের ভূখণ্ডের অংশ বলে চিহ্নিত করে। যা নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারত। এর কিছু দিন পর দূরদর্শন ছাড়া ভারতের সমস্ত বেসরকারি সংবাদমাধ্যমকেও নেপালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ওলি। পুরো বিষয়টি নিয়ে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেও বিভেদ তৈরি হয়েছে। দলের প্রধান তথা দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড ওলির কাজকে সমর্থন করেননি। দলের মধ্যে খানিক একাই হয়ে পড়েছেন ওলি। তারই মধ্যে তাঁর এই নতুন বিবৃতি। যাকে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই রাজনৈতিক বলে মনে করছেন।
ইতিহাসের অধ্যাপক অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ''ওলির এই দাবি ঐতিহাসিক ভাবে অর্থহীন। ঠিক যেমন অর্থহীন রামকে নিয়ে গেরুয়া শিবিরের রাজনীতি। যে কোনও মহাকাব্যেরই একটা ব্যপ্তি থাকে। তার বিবিধ ভার্সন এবং ব্যাখ্যা। রামায়ণের ক্ষেত্রেও তা সত্য। রামের মতো পৌরাণিক চরিত্রকে নিয়েও তাই নানা ব্যাখ্যা রয়েছে। শুধু তাই নয়, রামায়ণ অনুযায়ী রামের জন্ম অযোধ্যায়। এখন যে জায়গাটিকে অযোধ্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তা গোরখপুরের কাছে। গোরখপুর থেকে নেপালের সীমান্ত খুব বেশি নয়। ওলি যে জায়গার কথা বলছেন, তাও সীমান্ত থেকে খুব দূরে হওয়ার কথা নয়। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন নেপাল, ভারতের আলাদা অস্তিত্ব ছিল না। ফলে সবটাই মিলেমিশে ছিল। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক মানচিত্র দিয়ে মহাকাব্যের ব্যাপ্তিকে ধরা অসম্ভব। ফলে এই কথাগুলোরই কোনও অর্থ হয় না। এবং এই বিষয়গুলি নিয়ে তর্ক করারও মানে হয় না।''
ইতিহাস যা-ই বলুক, রাম-রাজনীতি চলছে এবং চলবে। ওলির বক্তব্যে তাই ক্ষুব্ধ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। অযোধ্যা মামলায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অন্যতম পক্ষ ছিল। রামলালার মামলাও তাদেরই করা। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সর্বভারতীয় সভাপতি বিষ্ণু সদাশিব কোকজে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''ওলি যা বলেছেন, তা আমরা কোনও দিন শুনিনি, পড়িওনি। একজন কমিউনিস্ট নেতার কাছ থেকে রামায়ণের কথা আমরা শুনতেও চাই না। তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ সব কথা বলেছেন।''
বিজেপি আরও কড়া ভাষায় ওলির বক্তব্যের নিন্দা করেছে। যুব বিজেপির অন্যতম সম্পাদক সৌরভ সিকদার ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''বেজিং যা বলতে বলছে, ওলি তাই বলছেন। চীন ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিকে ভারতের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ওলি সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন। তাই মানচিত্র বদলে, রামকে নেপালি বলে ভারতের সঙ্গে বিতর্ক তৈরির লাগাতার চেষ্টা চালাচ্ছেন।'' তাঁর আরও বক্তব্য, রামায়ণ বলে, সীতা মিথিলার মেয়ে। মিথিলা ভারত-নেপাল সীমান্তে সীতামড়ির কাছে। ফলে সীতাকে নেপালের বললে এত হইচই হতো না। কিন্তু অযোধ্যার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুললে বোঝা যায়, তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে।
সিপিএমের প্রবীণ নেতা নীলোৎপল বসু অবশ্য এই বিতর্কে ঢুকতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, রামায়ণের অসংখ্য ভার্সন। ঐতিহাসিকরা এ নিয়ে গবেষণা করতে পারেন। কিন্তু এর সঙ্গে রাজনীতি মেলানোর কোনও অর্থ হয় না। কমিউনিস্ট নেতা ওলি কেন রামরাজনীতির মধ্যে ঢুকলেন, সে বিষয়ে অবশ্য মন্তব্য করতে চাননি নীলোৎপলবাবু। যদিও বাবরি মসজিদ এবং রামজন্মভূমি বিতর্কে বরাবরই স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে এ দেশের বাম দলগুলি। বিষয়টি নিয়ে সংকীর্ণ রাজনীতির বরাবরই বিরোধিতা করেছে তারা।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, যে কায়দায় ভারতে রামজন্মভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে, তা প্রশ্নাতীত নয়। একজন পৌরাণিক চরিত্র কী ভাবে আদালতে মামলা করেন, তা নিয়েও প্রচুর আলোচনা এবং জলঘোলা হয়েছে। কোনও পৌরাণিক চরিত্রের বাস্তব জন্মভূমি চিহ্নিত করা যায় কি না, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বহু বিতর্ক হয়েছে এবং হচ্ছে। রামকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা নিয়েও আলোচনা কম হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেপালের প্রধানমন্ত্রী তথা কমিউনিস্ট নেতা ওলি যে মন্তব্য করেছেন, তা ইতিহাস চর্চার উদ্দেশ্যে করেননি, রাজনৈতিক অভিসন্ধি থেকেই করেছেন। ভারত-নেপাল বর্তমান সম্পর্কের প্রেক্ষিতেই এ কথা বলে বিতর্ক আরও একটু উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি।