1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হবেই’

হারুন উর রশীদ স্বপন, ঢাকা৩১ আগস্ট ২০১৬

সুন্দরবনের অদূরে বাংলাদেশের বাগেরহাটে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে চলছে জোর বিতর্ক৷ তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলন করে স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন যে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে এবং এতে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না৷

https://p.dw.com/p/1JsIg
সুন্দরবন
ছবি: DW/M. Mamun

বিদ্যুৎ প্রকল্পের খুঁটিনাটি

এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাগেরহাটের রামপালে ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রণ করে তা বালু দিয়ে এরইমধ্যে ভরাট করা হয়েছে৷ প্রকল্পটি বাংলাদেশের বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের মাত্র ৯-১৩ কিলোমিটারের মধ্যে৷ তবে সরকারের দাবি, সুন্দরবনের বাফারজোনের ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এটি৷

এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনের বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন (এনটিপিসি)-এর সঙ্গে দু'টি চুক্তি সই হয়েছে৷ রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র৷ তাই এই বিদ্যুৎ উদপাদনে ব্যবহার করা হবে কয়লা৷ আর সেই কয়লা ভারত থেকে আমাদানি করা হবে৷ জানা গেছে, এই প্রকল্পে অর্থের যোগান দেবে ভারতের এক্সিম ব্যাংক৷ প্রকল্পটি থেকে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, যার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৪০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা৷

বিদ্যুৎকেন্দ্রের দু'টি ইউনিটের মধ্যে প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে৷ ভারত এবং বাংলাদেশ প্রকল্পটিতে ৩০ ভাগ অর্থ বিনিয়োগ করবে৷ বাকি ৭০ ভাগ অর্থ ঋণ নেওয়া হবে৷ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করবে ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানি৷

আপত্তি যেসব জায়গায়...

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে কেন আপত্তি, তা সংবাদমাধ্যমে এক যৌথ বিবৃতির মাধমে জানিয়েছেন পরিবেশবাদী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা৷ তাঁদের মধ্যে আছেন হাসান আজিজুল হক, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সুলতানা কামাল, সৈয়দ আবুল মকসুদ, রাশেদা কে চৌধুরী, ইফতেখারুজ্জামান, বদরূল ইমাম, এম এম আকাশ, শফিক উজ জামান, এম শামসুল আলম, খুশী কবির, আবদুল মতিন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মলয় ভৌমিক, রোবায়েত ফেরদৌস, শরীফ জামিল প্রমূখ৷

এঁরা যা বলেছেন তার সারসংক্ষেপ

রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প হলে তার থেকে নির্গত কার্বন ও ছাইভস্মে আশপাশের বায়ু ও পানিদূষণ, নির্গত গ্যাসে বিদ্যমান ভারী ধাতু, সালফার ও নাইট্রেজেন অক্সাইড ছড়িয়ে পড়ায় বিস্তির্ণ এলাকার বায়ুদূষণ এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য পানি দ্বারা আশেপাশের জলাশয়ের পানিদূষণ ঘটবে৷

সুন্দরবনের চতুর্দিকে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন' এলাকা বলে ধরা হয়৷ এ রকম এলাকায় নিষিদ্ধ কার্যাবলি হলো: (ক) প্রাণী বা উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী সব কার্যকলাপ, (খ) ভূমি এবং পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট বা পরিবর্তন করতে পারে এমন সব কার্যকলাপ, (গ) মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দদূষণকারী প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকারক যে কোনো কার্যাবলি৷

২০১০ সালে সুন্দরবন এলাকার পশুর নদীকে অন্তর্ভুক্ত করে নদী ও খালের বেশ কিছু জলাভূমি জলজ প্রাণী সংরক্ষণের স্বার্থে ‘বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য' ঘোষণা করে৷ তেলবাহী ট্যাংকার ও মালবাহী কার্গো চলাচল অভয়ারণ্যের প্রাণিদের জন্য বিপজ্জনক হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌ-পথ নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দেন৷ সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় এবং ১০ কিলোমিটারের মধ্যে না হওয়ায়, দহনকৃত কয়লার মান ও পরিমাণগত তারতম্য বিবেচনায় না নিয়ে কেবল ব্যবহৃত প্রযুক্তির কারণে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সুন্দরবনবান্ধব বলা যায় না৷

রামসার ও ইউনেস্কো – উভয় কর্তৃপক্ষ ২০১২ সালে সরকারের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে৷ তারপরও উদ্বেগ আমলে নেওয়া হয়নি, এমন অভিযোগ উঠেছে৷ নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সরকারকে জানিয়েছে, কয়লাবাহী জাহাজ চলাচলে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে৷ পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলেছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই থেকে সালফার ডাই-অক্সাইড ছড়ানোর কারণে বন্য গাছপালা ধীরে ধীরে মারা যাবে৷ একই সঙ্গে অ্যাসিড নিঃসরণের কারণে ভূমির উৎপাদনক্ষমতা হ্রাস পাবে৷ এছাড়া বায়ুদূষণকারী উপাদানগুলো মেঘমালার মাধ্যমে ছড়াবে৷ নাব্যতা হ্রাস পাওয়া পশুর নদীর সংকট বাড়বে৷ অথচ আলট্রা সুপার থার্মাল প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এ সব কোনো ক্ষতি হবে না, এমন কথা বিজ্ঞানভিত্তিক নয়৷

বিচার-বিশ্লেষণে দেখা যায়: (ক) রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবন ও সেখানকার জীববৈচিত্র্যের জন্য অপূরণীয় ক্ষতিকর – এ প্রশ্নে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই৷ (খ) কয়লা-বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে মাত্রায় দূষক উৎপন্ন হয়, তাতে পরিবেশ দূষিত হয়৷ সুতরাং রামপালেও কয়লা-বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশ দূষিত হবে৷ এর পাশাপাশি কয়লা পুড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি বিষাক্ত গ্যাস ও বিষাক্ত ধাতব পদার্থ মিশ্রিত ছাই উৎপন্ন হবে৷ ফলত পানি ও মাটি দূষিত হবে৷ স্বাভাবিকভাবেই এ সব দূষণের কারণে সুন্দরবনের জীব ও উদ্ভিদ বিপন্ন হবে৷

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশবাসী জনপ্রতি মাত্র ৮ ওয়াট বিদ্যুৎ পাবে৷ এ বিদ্যুতে একটি এনার্জি সেভিং বাল্ব জ্বালানোও কঠিন৷

সরকারের না...

বিশিষ্ট নাগরিকদের এই অভিমত আমলে নিচ্ছেন না সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ৷ গত শনিবার এব সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের পক্ষে তাঁর সরকারের অবস্থান তুলে ধরেছেন৷ বলেছেন, ‘‘রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প হবে এবং এতে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না৷'' তিনি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে তাঁর সরকারের যুক্তি তুলে ধরে বিরোধিতাকারীদের কঠোর সমালোচনা করেন৷

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘গুলশানে হলি আর্টিজানে মানুষ খুন হলো এমন একটা সময়, যখন বাংলাদেশে বিনিয়োগের সব থেকে সুন্দর পরিবেশ ছিল৷ বিশ্বব্যাপী মানুষ উন্মুখ হয়ে ছিল বাংলাদেশে আসবে, বিনিয়োগ করবে৷ ঠিক সে সময় কয়েকটা ঘটনা ঘটিয়ে বিনিয়োগটাকে থামানো, উন্নয়নটাকে থামানোর চেষ্টা হলো৷ ঠিক একইভাবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও আন্দোলনের নামে এত কথা এবং বাধা দেওয়া হচ্ছে৷ এই দু'টোর মধ্যে আমি খুব বেশি একটা তফাৎ দেখি না৷ আমার মনে হয়, বাংলাদেশ যে গতিতে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল, সেখানে তাকে থামিয়ে দেওয়াই যেন ছিল তাদের একটা চেষ্টা৷''

বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে৷ অন্যদিকে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি আবারো এই প্রকল্প পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছে সরকারের কাছে৷ সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেছে, পুনর্বিবেচনার চিন্তা করলে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি আলোচনাতেও রাজি৷

এদিকে সোমবার রামপাল প্রকল্প বাতিল না হওয়া পর্যন্ত দুর্বার আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ৷ তিনি বলেন, গণজাগরণ সৃষ্টি করে আন্দোলনকে আরও বেগবান করা হবে৷

নতুন আশঙ্কা

ওদিকে শুধু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, এটা স্থাপন হলে আরো কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে – তা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে৷ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুবিধা নিতে সুন্দরবনের আশপাশে শিল্প কারাখানা স্থাপনে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে৷ এরইমেধ্যে ৩০০টি শিল্পগোষ্ঠী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আশেপাশের গ্রামগুলোর প্রায় ১০ হাজার একর জমি কিনেছেন৷ এর মালিকদের অধিকাংশই রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি৷

ছাড়পত্র পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৫০টি চালকল, ১৯টি করাতকল, ৯টি সিমেন্ট কারখানা, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান ১৩টি, ৬টি অটো মিল, ৪টি লবণ-পানি বিশুদ্ধকরণ প্রকল্প, দু'টি জাহাজ নির্মাণ প্রকল্প এবং অন্যান্য ৩৮টি প্রকল্প রয়েছে৷

পরিবেশ অধিদপ্তর সুন্দরবনের ১০ কি.মি. এলাকায় এরইমধ্যে ১৫০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং প্রকল্পকে অবস্থানগত ছাড়পত্র দিয়েছে৷ যদিও সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কি.মি. এলাকা এখনও ‘সংকটাপন্ন এলাকা' হিসেবে চিহ্নিত৷

ইকবাল হাবিব

প্রধানমন্ত্রীর উচিত আলোচনা করা

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের মুখপাত্র স্থপতি ইকবাল হাবিব ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত চার বছর ধরে আমারা রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে কথা বলছি৷ শুরুতে এই প্রকল্পে অনেক ত্রুটি ছিল৷ সরকার বলছে যে, সে ত্রুটি কাটানো হয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রী জার্মানিসহ আরো অনেক উন্নত দেশের উদাহরণ দিয়েছেন সংবাদ সম্মেলনে৷ কিন্তু আমার প্রশ্ন, আমাদের সেই ব্যবস্থাপনা এবং দক্ষতা আছে কিনা৷ আমি বলব নেই৷ এই প্রকল্পের ফলে যে ক্ষতি হবে, তা মনিটর এবং বন্ধ করার কোনো ব্যবস্থানা আমাদের নেই৷ তাই যাই বলা হোক না কেন, এই প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখেই আছে৷ যারা বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধ করতে পারে না, তারা কীভাবে রামপাল বিদ্যুৎকন্দ্রের দূষণ রোধ করবে?''

তাঁর কথায়, ‘‘এই প্রকল্প নিয়ে নানা মহল থেকে কথা হচ্ছে৷ পরিবেশবাদীরা কথা বলছেন, পেশাজীবীরা কথা বলছেন, বিজ্ঞানীরা কথা বলছেন৷ আলোচনার দরজা বন্ধ হয়ে যায়নি৷ তাই সবাইকে কাছে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কথা শোনা উচিত৷ কারুর দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ নয়, বরং দেশের স্বার্থেই সবার যৌক্তিক এবং তথ্যভিত্তিক বক্তব্য আমলে নেয়া উচিত৷''

বন্ধু, আপনি কি প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্বাস করেন? মনে করেন যে রামপালে বিদ্যৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না? লিখুন নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান