রাশিয়ায় এলজিবিটিকিউদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে
৩ ডিসেম্বর ২০২৩রাশিয়ার বিচার মন্ত্রণালয়ের এক উদ্যোগের প্রেক্ষিতে ৩০ নভেম্বর রাশিয়ার সুপ্রিম কোর্ট ‘আন্তর্জাতিক এলজিবিটি সামাজিক আন্দোলনকে' একটি ‘চরমপন্থি' সংগঠন হিসেবে নথিভুক্ত করেছে৷
আইনজীবীদের আশঙ্কা এই রায়ের ফলে মানবাধিকার আন্দোলনকারী এবং এলজিবিটিকিউ+ প্রতীক ব্যবহারকারী, এবং যারা অনুদান দিয়ে তাদের সহায়তা করেন বা প্রথাবিরোধী মূল্যবোধের সমর্থন করেন তারা এখন নিপীড়নের শিকার হতে পারেন৷ ১০ জানুয়ারি থেকে রাশিয়ায় এলজিবিটিকিউর সঙ্গে সম্পর্কিত যে কারো উপর এই রায় কার্যকর হবে৷
তবে এই সংক্রান্ত নিয়ম বা সিদ্ধান্তগুলো এখনও অপ্রকাশিত রাখা হয়েছে৷ তবে চরমপন্থি সংগঠনের সদস্য হিসেবে কোন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১২ বছরের কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে পারেন৷
আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ প্রতীক প্রদর্শনের প্রথম অপরাধে অভিযুক্তকে এক হাজার থেকে দুই হাজার রুবেল (১০ থেকে ২০ ইউরো) জরিমানা অথবা ১৫ দিন পর্যন্ত আটক রাখা হতে পারে। দ্বিতীয়বার নিয়ম ভাঙলে চার বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ছয় লাখ থেকে ১০ লাখ রুবেল জরিমানা করা হতে পারে৷
রুশ মানবাধিকার গোষ্ঠী পেরভি ওটডেলের আইনজীবী ম্যাক্সিম ওলেনিচেভ ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘নিষিদ্ধ প্রতীকের আওতায় কী পড়বে তা আদালতের সিদ্ধান্তে উল্লেখ থাকা উচিত৷'' তাই এলজিবিটিকিউ আন্দোলনের রংধনু রঙের পতাকা নিষিদ্ধ হবে কি না তা এখনও স্পষ্ট নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি৷
ওলেনিচেভ বলেন, বিচার মন্ত্রণালয়ের এই মামলায় কোনও বিবাদী পক্ষ ছিল না৷ যে কারণে এর বিরুদ্ধে আপিল করার আইনি অবস্থান কারো নেই৷ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার জন্য নভেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল এলজিবিটি সোশ্যাল মুভমেন্ট নামে আন্দোলনকারীরা একটি সংগঠন নিবন্ধন করলেও বিচার মন্ত্রণালয় সুপ্রিম কোর্টে নেয়া পদক্ষেপে তাদেরকে উপেক্ষা করেছে৷
এলজিবিটিকিউদের উপর শত্রুভাবাপন্ন আচরণের কারণে অনেক অ্যাক্টিভিস্ট দেশটি ছেড়ে চলে গেছেন, যার মধ্যে রয়েছেন সেন্টার টি-এর কর্মীরাও৷ এই উদ্যোগটি ট্রান্সজেন্ডারদের সমর্থনে কাজ করে৷ তবে কাজের জন্য বাধ্য হয়ে তাদের কেউ কেউ এখন রাশিয়ায় রয়ে গেছেন৷
সেন্টার-টি এর নেতা এবং প্রতিষ্ঠাতা জ্যান ডভোরকিন নিজেও আর রাশিয়ায় থাকেন না৷ তিনি বলেন, ‘‘যারা তাদের পরিচয় বা লিঙ্গ বদলের কারণে নির্যাতিত বা যাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, তাদের জন্য আবাসনসহ জরুরি সহায়তা করা হতো৷ তবে নিরাপত্তার কারণে, আমরা আর এই ধরনের পরিষেবার বিজ্ঞাপন দেব না৷''
তবে নিজেদের সদস্য ও মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে অনলাইনে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চান তারা৷ জানান, ‘‘আমরা খুব সম্ভবত কোনো ভিডিও লিঙ্ক ছাড়াই এবং শুধুমাত্র যাচাই করা অংশগ্রহণকারীদের নিয়েই সম্মেলন চালিয়ে যাব৷''
২০১১ সাল থেকে রাশিয়ায় এলজিবিটিকিউদের অধিকারের জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে স্ফেরা৷ গ্রুপের আইনি সহায়তা প্রকল্পের প্রধান একাতেরিনা ডিকোভস্কায়া ডিডাব্লিউকে বলেন, তার দলেরও কর্মীদের একটি আংশ বিদেশে থাকেন এবং একটি নিরাপদ অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে বেশিরভাগ কাজ ও যোগাযোগ চালান তারা৷ তিনি বলেন, ‘‘এলজিবিটিকিউ ছাড়াও এই গোষ্ঠীর সমর্থনকারী মানুষজনবা উকিলদের জন্য হুমকি তৈরি করছে এই আইন৷ আমাদের দলের সদস্যদের এবং আমাদের অনুদান যারা দেন, তাদের বিরুদ্ধেও ফৌজদারি মামলার ঝুঁকি রয়েছে৷''
ভাইবোর্গ-এর এক আলোকচিত্রী রোসা রাশিয়ায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ আতঙ্ক এড়াতে এবং আরো দমন-পীড়নের ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে তিনি সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আইনজীবীদের আলোচনাকে ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করছেন৷ তার কথায়, ‘‘আমি এখনও জানি না কীভাবে আমি অন্যদের রক্ষা করব, কারণ আমি বিদেশি মিডিয়াতে এলজিবিটিকিউদের গল্প প্রকাশ করি৷ ছবিতে তাদের মুখগুলি ঝাপসা করা উচিত কি না তা স্পষ্ট নয়৷''
পুটিনের পুনঃনির্বাচনের সঙ্গে যোগ?
সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের আগে, প্রেসিডেন্ট পুটিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, এলজিবিটিকিউ আন্দোলনকে চরমপন্থি হিসাবে ফের শ্রেণীভুক্ত করার জন্য বিচার মন্ত্রণালয়ের আহ্বানের সঙ্গে ক্রেমলিনের কোনো যোগ নেই৷
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন শীঘ্রই পঞ্চম মেয়াদের জন্য প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
এলজিবিটিকিউ কর্মীদের অনেকে বলছেন, নিষেধাজ্ঞার জন্য ঐতিহ্যগত ‘পারিবারিক মূল্যবোধ' কে কারণ হিসাবে দেখাতে চায় ক্রেমলিন যা, পুটিনের পুনঃনির্বাচনের প্রচারকে জোরদার করার একটি প্রচেষ্টা হতে পারে৷
কারাবন্দি বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনির দুর্নীতিবিরোধী ফাউন্ডেশনের প্রধান ইভান ঝদানভ টেলিগ্রামে লিখেছেন, ক্রেমলিন প্রকৃত সমস্যা থেকে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চায়৷ রাশিয়ারক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার পরিপ্রেক্ষিতে, ‘‘কাল্পনিক শত্রুর কথা বলে নানা কারণে জনগণের মধ্যে (সরকার) বৈষম্য তৈরি করছে৷''
২০১৩ সালে অপ্রাপ্তবয়স্কদের ‘অপ্রথাগত যৌন সম্পর্কের প্রচার'নিষিদ্ধ করার আইনে সই করেন পুটিন৷ এটিকে এখন গে প্রোপাগান্ডা ল বলা হয়৷ ২০২০ সালে, সমকামী বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ ২০২২ সালে, ‘এলজিবিটি প্রচার' নিষিদ্ধ করা হয়েছিল প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও৷ ২০২৩ সালে, রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ ‘অপ্রথাগত যৌন সম্পর্কের প্রচার' বলে মনে করে এমন কোনো সামগ্রীর বিতরণও নিষিদ্ধ করে৷
প্রকাশনা, বইয়ের দোকান, পাঠাগার এবং ফিল্ম প্ল্যাটফর্মগুলিকে জরিমানার হুমকি দেখিয়ে সমকামী সম্পর্কের যে কোনো উল্লেখ মুছে ফেলতে বাধ্য করা হয়৷ ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের অফিসিয়াল নাম পরিবর্তন নিষিদ্ধ করা হয়।
আলেক্সি স্টেনলিকভ/আরকেসি