রাশিয়া ও ইউরোপ: সংঘাত না আপস?
২৮ আগস্ট ২০০৮কসোভো থেকে জর্জিয়া
জর্জিয়ার সঙ্কট একেবারে অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা নয়৷ সার্বিয়া থেকে কসোভো প্রদেশ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময়েই এমন একটা আশঙ্কা জেগে উঠেছিল৷ ইউরোপের অনেক দেশ যেভাবে সার্বিয়ার সম্মতি ছাড়াই কসোভোর স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিতে প্রবল উত্সাহ দেখিয়েছিল, রাশিয়া তাতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিল৷ জর্জিয়ার ঐক্য ও অখণ্ডতা এভাবে বিপন্ন হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপ কসোভোর সঙ্গে ককেশাস অঞ্চলের তুলনা মানতে নারাজ৷ ব্রাসেলস-এ ই.ইউ.-র মহল মনে করে, সাবেক ইয়ুগোস্লাভিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই অন্তর্নিহিত ছিল কসোভোর সমস্যা৷ অন্যদিকে জর্জিয়ার সঙ্কটের চরিত্র একেবারেই আলাদা৷
ইউরোপের প্রতিক্রিয়া
আগামী ১লা সেপ্টেম্বর ই.ইউ.-র শীর্ষ নেতারা জর্জিয়ার সঙ্কট ও রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের ভবিষ্যত্ সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনা করতে এক জরুরী বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন৷ আপাতত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে ক্ষতি হয়েছে, তা অনস্বীকার্য৷ কোনো পক্ষই অবশ্য এই কারণে সংলাপ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে চায় না৷ কিন্তু ইউরোপের মধ্যেও রাশিয়ার প্রশ্নে মতপার্থক্য রয়েছে৷ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের জোটসঙ্গী হিসেবে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা বাকিদের তুলনায় আলাদা৷ জর্জিয়ার ঘটনাকে তারা বিচ্ছিন্ন এক প্রবণতা হিসেবে দেখছে না৷ জর্জিয়ার ঐক্য ও অখণ্ডতা এভাবে বিপন্ন হওয়ায় তারা অত্যন্ত শঙ্কিত৷ পোল্যান্ড ও বাল্টিক অঞ্চলের দেশগুলি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ই.ইউ.-র কড়া অবস্থান দেখতে চায়৷ ব্রিটেনও এই অবস্থানের প্রতি সম্মতি দেখাচ্ছে৷
এই অবস্থায় অত্যন্ত বিপাকে পড়েছে ফ্রান্স৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান সভাপতি দেশ হিসেবে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সার্কোজ়ি জর্জিয়ার সঙ্কট মেটাতে যে ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং সাফল্যের দাবি করেছিলেন, রাশিয়ার একতরফা ঘোষণার ফলে তা ম্লান হয়ে পড়েছে৷ সেইসঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সার্কোজ়ির কর্তৃত্বও প্রশ্নের মুখে পড়েছে৷ তিনি ৬ দফা এক চুক্তির মাধ্যমে ককেশাস অঞ্চলে আপাতত শান্তি আনতে চেয়েছিলেন৷ রাশিয়া ও জর্জিয়া - দুই পক্ষই সেই চুক্তি স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত রাশিয়া আবখাজ়িয়া ও দক্ষিণ ওসেটিয়ার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ সোমবার ই.ইউ. শীর্ষ সম্মেলনে তাঁকেই পৌরোহিত্য করতে হবে এবং আবার মস্কোর কাছে ই.ইউ.-র বার্তা পৌঁছে দিতে হবে৷
বৃহত্তর স্বার্থ
রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে বর্তমান সঙ্কটের রেশ কতকাল চলবে - তা এখনো স্পষ্ট নয়৷ এই অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে অন্যান্য ক্ষেত্রে যে সহযোগিতা ও পারস্পরিক নির্ভরতা রয়েছে, সেই চলমান প্রক্রিয়া কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ এই মুহূর্তে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জ্বালানীর চাহিদার একটা বড় অংশ মেটাচ্ছে রাশিয়া৷ জ্বালানী তেলের প্রায় ২০ শতাংশ এবং গ্যাসের ৪০ শতাংশই আসে রাশিয়া থেকে৷ ইউরোপ বিভিন্ন ভাবে এই নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নিলেও সেই লক্ষ্য পূরণ করতে বেশ কয়েক বছর সময় লাগবে৷ ২০১২ সাল থেকে বল্টিক সাগরের নিচে পাতা পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে সরাসরি গ্যাস আসবে জার্মানিতে৷ ফলে কিছু ক্ষেত্রে নির্ভরতা আরও বাড়তে চলেছে৷ অন্যদিকে ইউরোপের এই চাহিদা পূরণ করতে রাশিয়ার পরিকাঠামোর যে উন্নয়নের প্রয়োজন, তার জন্য প্রযুক্তি আসবে ইউরোপ থেকে৷ ফলে রাশিয়াও ইউরোপের উপর এক্ষেত্রে নির্ভরশীল৷ ইউরোপের উপর রাশিয়ার নির্ভরতার অন্য কারণও রয়েছে৷ রাশিয়ার আমদানীর প্রায় ৫২ শতাংশ আসে ইউরোপ থেকে৷ রাশিয়ায় সরাসরি বিদেশী লগ্নির প্রায় ৬০ শতাংশের ভাগীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ আফগানিস্তান, ইরান, মধ্যপ্রাচ্য ইত্যাদি অনেক আন্তর্জাতিক সঙ্কটের ক্ষেত্রেও ইউরোপ ও রাশিয়া এতকাল এক সমন্বয়ের চেষ্টা চালিয়ে এসেছে৷
রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের বর্তমান উত্তেজনা কি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলবে? রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে পারস্পরিক নির্ভরতা গড়ে উঠেছে, তা কি রাতারাতি ছিন্ন করা সম্ভব? এই সব প্রশ্নের উত্তর জানতে আমরা কথা বলেছি নেদারল্যান্ডসের লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পেটার কাস্টার্স-এর সঙ্গে৷