যক্ষ্মারোগ
১৯ মে ২০১২এশিয়া মহাদেশের অন্তর্গত রাশিয়ার অপেক্ষাকৃত অনুন্নত পূর্বাঞ্চলে যক্ষ্মারোগের আধিক্যটা বেশি৷ জীবনযাত্রার মান ও চিকিত্সার সুযোগ সুবিধার দিক দিয়ে এই অঞ্চল রাশিয়ার অন্যান্য এলাকার চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে আছে৷ ভাগ্য ভাল থাকলে এখানকার অধিবাসীরা মস্কোর কেন্দ্রীয় টিবি ইন্সটিটিউটের কোনো এক ক্লিনিকে চিকিত্সা করাতে পারেন৷
যক্ষ্মার চিকিত্সায় অবহেলিত রাশিয়ার পূর্বাঞ্চল
দেখা যাক এই রকমই একটি ক্লিনিকের দৃশ্য: ভবনটির সামনের দিকটা সাদা৷ প্রবেশ পথে চমত্কার চারটি পিলার৷ মস্কোর শহরতলীর এক বনাঞ্চলে অবস্থিত ক্লিনিকটি৷ যক্ষ্মায় আক্রান্ত ২৭ বছরের লারিসা এসেছেন এই ক্লিনিকে চিকিত্সা নিতে৷ শরীর দেখলে মনে হবে ১৩ বছরের এক কিশোরী, অন্যদিকে চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ৷
লারিসা জানান, ‘‘আমার মামা আমার মাকে ও আমাকে সংক্রামিত করেছেন৷ অসুখটি অনেক দিন তিনি গোপন করে রেখেছিলেন৷ কোথা থেকে তাঁর এই সংক্রমণ হয়েছিল, তা আমরা জানিনা৷ আমার মা দেড় বছর আগে মারা গেছেন৷ আমি ২০০৬ সাল থেকে ভুগছি৷''
লারিসা পশ্চিম সাইবেরিয়ার শহর টিউমেন থেকে এসেছেন৷ নিজের শহরে বেশ কটি থেরাপি নিয়েছেন এই তরুণী৷ ফুসফুসের একটি অপারেশনও হয়েছে৷ কিন্তু আরোগ্য লাভ না করায় বন্ধুদের সহায়তায় শেষ শক্তি নিয়ে মস্কোয় এসেছেন৷ মাস ছয়েক ধরে কেন্দ্রীয় টিবি ইন্সটিটিউটের এক ক্লিনিকের রোগী তিনি৷ শ্বাসপ্রশ্বাসে এখনও কষ্ট হলেও আগের চেয়ে ভাল আছেন লারিসা৷
লারিসার ভাষায়, ‘‘এখানকার নিয়ম কানুন বেশ কড়া, বিশেষ করে টিউমেনের ক্লিনিকের সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায় এটা৷ আমাদের ক্লিনিক থেকে বের হতে দেয়া হয়না৷ ক্লিনিকের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করার সময় মাস্ক পরতে হয় আমাদের৷ কোনো ব্যাতিক্রম করা যাবে না৷ সব ওষুধপত্রই ডাক্তার বা নার্সদের সামনে খেতে হয়৷ আমার রোগটি এখন ভালোর দিকে৷ টিউমেনে কিন্তু মারা যাওয়ার জন্য বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল আমাকে৷ এতেই বোঝা যায়, চিকিত্সাটা সেখানে কীরকম৷''
বিশেষ করে নিম্নবিত্তের মানুষরাই যক্ষ্মাক্রান্ত হয়
রাশিয়ার বিশেষ করে উরাল পর্বতমালার পূর্বাঞ্চলে যক্ষ্মারোগীর সংখ্যা বেশি, চিকিত্সার মানও খারাপ৷ বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থার তথ্য অনুযায়ী রাশিয়ায় ২০১০ সালে যক্ষ্মাক্রান্তের হার ছিল প্রতি এক লাখে ১০০ জন, জার্মানিতে সেই বছর এক লাখে মাত্র পাঁচ জন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়৷ এই রোগে মৃত্যুর হার জার্মানিতে ০.২৫ শতাংশ, রাশিয়ায় ১৮ শতাংশ৷
ক্লিনিকের মহামারি ও পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান ভিক্টর পুংগো এর কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘‘রাশিয়ার সামাজিক অবস্থা সব দিক দিয়ে আদর্শিক, এই কথা মোটেও বলা যাবে না৷ উন্নত দেশগুলির মত সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারলেই কেবল যক্ষ্মারোগের ক্ষেত্রে দুরবস্থার পরিবর্তন হবে৷ যক্ষ্মাক্রান্তদের তিন ভাগের দুই ভাগই নিম্নবিত্তের মানুষ৷ টিবির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাফল্য পেতে হলে জীবনযাত্রার মানের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে ৮৫ শতাংশ, আর ১৫ শতাংশ চিকিত্সা ক্ষেত্রে৷ অবশ্য উচ্চবিত্তের মানুষরাও যে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন না তা বলা যায় না, তবে তুলনামূলকভাবে কম৷''
এইচআইভি আক্রান্তদের ঝুঁকি বেশি
৯০ এর দশকে সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর চারিদিকে বিশৃঙ্খলা ও দারিদ্র্য মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়৷ যক্ষ্মায় আক্রান্তেরও সংখ্যা তিন গুণ বৃদ্ধি পায়৷ ইদানীং অবশ্য কিছুটা ইতিবাচক হাওয়া বইছে সেখানে৷ রুশ সরকার যক্ষ্মা মহামারির বিপদটা বুঝতে পেরে এ ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করছে৷ তবে একটি বিষয় অবস্থাকে জটিল করে তুলছে, আর তা হল এইচআইভি'তে সংক্রমণের উঁচু হার৷ এই ভাইরাসে আক্রান্তদের রোগ প্রতিরোধ শক্তি কমে যায় বলে টিবিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়৷ এ ছাড়া রাশিয়ায় যক্ষ্মা রোগীদের অনেকে এমন ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন, যে গুলিকে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক কাবু করতে পারছে না৷ সাধারণত এমনটি হয়ে থাকে, নিয়মিত ওষুধ না খেলে৷ তা সে অজ্ঞতা, অবহেলা ওষুধপত্র না পাওয়া, যে কারণেই হোক না কেন৷
মাইক্রোবায়োলজি গবেষণাগারের প্রধান লারিসা চেরনোউসোভা এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমাদের খুঁজে বের করতে হয়, যক্ষ্মা রোগীদের .কোন কোন ওষুধ সাহায্য করতে পারে৷ এই কারণে আমরা এই গবেষণাগারটি পেয়েছি৷ আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে আমরা দ্রত যক্ষ্মার জীবাণু ও তার প্রতিরোধ শক্তি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পারি৷ তারপর সঠিক ওষুধটি নির্ণয় করতে পারি৷''
গবেষণাগারটি মস্কোর যক্ষ্মা ইন্সটিটিউটের সেলারে অবস্থিত৷ রাশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে যক্ষারোগটি এখনও অবহেলিত৷ এই সমস্যাটি জার্মানি ও পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশেও এসে পড়তে পারে৷ যক্ষ্মার প্রকোপ এই সব দেশ থেকে প্রায় দূর হলেও রাশিয়ার সঙ্গে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হওয়ার ফলে এই রোগে সংক্রমণের আশঙ্কাও বৃদ্ধি পাচ্ছে৷
প্রতিবেদন: রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ