রাষ্ট্রের মেরামতে ওরা
২ আগস্ট ২০১৮প্রিয়ন্তিকা মাত্রই লিখতে পড়তে শিখছে৷ তাঁর মনে অনেক প্রশ্ন৷ মা লাবণ্যের কাজের চাপ থাকায় প্রিয়কে ব্যস্ত রাখতে একটি বড় কাগজে অনেক কিছু লিখে এরপর একে কেটে কুটে ওলটপালট করে পাজলের মতো করে তার সামনে দিলেন৷ বললেন, ‘‘শব্দগুলো মিলাও তো দেখি সোনা৷''
হাফ ছেড়ে বাঁচলেন৷ কিছুটা সময় তো মেয়ে ব্যস্ত থাকবে৷ মনোযোগী হলেন কাজে৷ কিন্তু কিসের কী? একটু পরই কাগজ মিলিয়ে হাজির হলো মেয়ে৷ ওমা! ও তো খুব সহজেই করে ফেললো৷ প্রিয়কে আবার আরেকটি টাস্ক দিলেন লাবণ্য৷ এবার আরেকটু কঠিন৷
এবারো একটু পরই মেয়ে সব মিলিয়ে নিয়ে এলো৷ মা তো খুব আশ্চর্য হলেন৷ কীভাবে পারছে মেয়ে? নিজের কৌতূহল আটকাতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কীভাবে করলে তুমি মা?'' প্রিয়ন্তিকা বললো, ‘‘ওমা! এত সহজ৷ কাগজটির পেছনে একটি ছবি আছে দেখো৷ ওটা মিলিয়ে নিচ্ছি৷''
গল্পটি অনেকেরই পরিচিত৷ এর সারকথাও জানি আমরা৷ শিশুরা সৃজনশীল৷ তারা খুব দ্রুত সমস্যা সমাধানের বিকল্প সহজ সমাধান বের করতে পারে৷ গত ক'দিন ধরে নিরাপদ সড়কের দাবি ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন দেখে এই গল্পটি বারবার মনে পড়েছে৷
আন্দোলনকারীদের পক্ষে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি বক্তব্য হলো, ‘হাঁটেন, হাঁটতে থাকেন৷ রাস্তা বন্ধ৷ রাষ্ট্রের মেরামতের কাজ চলছে৷' কী সহজ কথা৷ কিন্তু কতটা গভীর!
কথাটিতে বাগাড়ম্বর নেই৷ নেই আবেগের আতিশয্য৷ এই শিক্ষার্থীদের বয়স কতই হবে৷ টিনএজ পার হয়নি কেউই৷ অথচ কত বড় কথা তারা বলে ফেলেছে!
বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক-লেখক ভলতেয়ার তাঁর ১৭৫৯ সালে প্রকাশিত বই কাঁদিদ-এ প্রচলিত বেশকিছু দর্শনকে আক্রমণ করেছিলেন৷ ‘‘ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন'', কিংবা ‘‘ঈশ্বর অনেককিছুই করেন যার মধ্যে মঙ্গলের কিছু নেই'' – এই দুই ধারণার মধ্যে শেষ পর্যন্ত তাঁর দর্শন হলো, এ নিয়ে বিতর্ক বা মারামারি না করে, বরং চলুন যাই, ‘‘মাঠে অনেক কাজ পড়ে আছে৷''
উলটো করে ছবি মিলিয়ে দেয়া কাল্পনিক চরিত্র প্রিয়ন্তিকা বা কাঁদিদের দর্শনকেই যেন বাস্তবে রূপ দিচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা৷ ‘রাষ্ট্রের মেরামত' করছে তারা৷ যখন বড়রা সবকিছু নিয়ে এ ওকে দোষারোপ করতে ব্যস্ত, লুটে পুটে খেয়ে সিস্টেমকে নামসর্বস্ব করতে ব্যস্ত, তখন এই ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে সিস্টেম মেরামত করছে৷ মাঠে কেমন করে কাজ করা উচিত তা দেখিয়ে দিচ্ছে৷ ঘুনে ধরা সিস্টেমকে কীভাবে ‘টাইট' দিয়ে সোজা বানানো যায়, তা করে দেখাচ্ছে৷
আর ভালো কাজ করলে কীভাবে জনসমর্থন পাওয়া যায়, তা প্রমাণ করেছে৷ এ থেকে আমাদের নীতিনির্ধারকগণ কি কিছু শিখবেন? রাষ্ট্রের মেরামতে ক্ষুদে হাতগুলোকে শক্ত করবেন? নাকি পিটিয়ে ভেঙে দেবেন? রাষ্ট্রের মেরামত হলে তো অনেকের উপরি বন্ধ হয়ে যাবে৷
প্রথম আলো পত্রিকায় ‘পরিবহণ খাত মন্ত্রী সাংসদসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের কবজায়' এই শিরোনামে আজ একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে৷ সেই প্রতিবেদনের হাইলাইটস হলো,
‘প্রভাবশালী রাজনীতিকেরা মালিক-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে
বিআরটিএ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নেয় না
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা বেনামে ব্যবসায় যুক্ত
ক্ষমতার ছায়ায় থাকা চালকেরাও বেপরোয়া
সড়কে অকাতরে প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ মানুষের'
(প্রথম আলো ০২.০৮.২০১৮)
প্রিয়ন্তিকার মা যে পাজলগুলো দিয়েছিলেন তা আসলে এগুলোই৷ যুগের পর যুগ ধরে তৈরি হওয়া একটা অরাজকতার মহীরূহে পরিণত হওয়া সিস্টেমকে স্বাভাবিক করাই এর লক্ষ্য৷
<iframe src="https://www.facebook.com/plugins/video.php?href=https%3A%2F%2Fwww.facebook.com%2Fdw.bengali%2Fvideos%2F10155600398700978%2F&show_text=0&width=560" width="560" height="315" style="border:none;overflow:hidden" scrolling="no" frameborder="0" allowTransparency="true" allowFullScreen="true"></iframe>
এই চিত্র নতুন কিছু নয়৷ এ সম্পর্কে সবাই কমবেশি জানেন৷ ক্ষমতার পালাবদলে এসব সংগঠনের নেতৃত্বও বদলায়, কখনো কখনো ব্যবসার মালিকানাও৷ যুক্ত হয় নতুন মালিকানা৷ কিন্তু সিস্টেম বদলায় না৷
মুনাফাভোগীরা সিদ্ধহস্ত৷ তারা জানেন কীভাবে সিস্টেমকে জিম্মিকরা যায়৷ কীভাবে জনদুর্ভোগ তৈরি করে ফায়দা লোটা যায়৷ বারবারই তাই করেছেন৷ এবারো যানবাহনের নিরাপত্তা নেই এমন অজুহাতে রাস্তায় গাড়ি বন্ধ করে অপকৌশল নিয়েছেন৷ কিন্তু তারুণ্যের বাধভাঙ্গা প্রতিরোধ ও মানুষের সীমাহীন সমর্থন এই আন্দোলনকে একটি অনন্য উদাহরণ হিসেবে সামনে এনেছে৷
তবে এর আগেও আমরা দেখেছি, কীভাবে বড় বড় আন্দোলনকে নানাভাবে ট্যাগ দিয়ে দুর্বল করে দেয়া হয়৷ প্রপাগাণ্ডার এই যুগে এই কাজটি খুব সহজ৷ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে জড়ো হওয়া হাজারো মানুষকে, তাদের আন্দোলনকে, কী সুচারুরূপে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে ধর্মের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়৷ মুক্তিযুদ্ধকে ধর্মের বিপক্ষে দাঁড় করানোর অপশক্তি তো সরব আছেই দেশে৷
আমরা দেখেছি, ‘কোটা সংস্কারের' আন্দোলনকেও ‘কোটা বিরোধী' বানিয়ে ফেলতে৷ এই আন্দোলনের মূলে না গিয়ে বরং একে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী আখ্যা দিয়ে একটি সাধারণীকরণ করার চেষ্টাও দেখেছি খোদ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে পরিচিত সরকারি দলের কাছ থেকেই৷
কিন্তু সড়কে আর প্রাণ ঝরবে না, এই দাবি সবার৷ এই আন্দোলনকেও নানাভাবে ব্যবহার করা হতে পারে, এমন শঙ্কা করেছেন অনেকেই৷ কিন্তু এই তরুণরা সতর্ক৷ তাদের স্লোগান ‘রাষ্ট্রের' মেরামত করার৷ কোনো সরকারের নয়৷ তাদের কোনো নেতা নেই৷ তারা স্বতঃস্ফূ্র্ত৷ তারা সবুজ প্রাণ৷ তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন অভিভাবকরা৷ শক্তি যোগাচ্ছেন৷ সাহস যোগাচ্ছেন৷
পাজলের উলটো দিকের ছবিটা মেলাচ্ছেন তারা৷ আমরা এখনো সেই ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছি৷ সোজা করে এখনো দেখিনি যে, মূল ধাঁধাটি মিলল কি না৷ আমরা চাই সেটি মিলুক৷ তা মেলানোর দায়িত্ব আপনাদের, যারা রাষ্ট্র চালান৷ যদি তা না করেন, তাতে হতাশ হয়ে এই সবুজ তারুণ্য যদি ‘রাষ্ট্রের মেরামত'-এর দ্বিতীয় পর্ব শুরু করে, তাহলে কারো চাকরি থাকবে না৷
ব্লগটি আমাদের কেমন লাগলো লিখুন নীচের ঘরে৷