রূপগঞ্জের বীর নারী মুক্তিযোদ্ধা মিনারা বেগম ঝুনু
১২ সেপ্টেম্বর ২০১২ভুল করে শান্তিবাহিনীর এক নেতার বাড়িতে উঠেও তাঁর ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে পাঠানোর জন্য রাজি করান তাঁরা৷
বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার দাউদপুর গ্রামে ১৯৫২ সালের ১লা নভেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন মিনারা বেগম ঝুনু৷ পিতা শামসুল ইসলাম ভুইয়া এবং মা জুবাইদা বেগম৷ ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় থেকেই ছাত্রলীগের কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়েন এই সমাজ সচেতন নারী৷
প্রথমে ঢাকার গভর্নমেন্ট ইন্টারমেডিয়েট গার্লস কলেজ এবং পরে তেজগাঁও কলেজের ছাত্রী ছিলেন মিনারা বেগম৷ কলেজ ছাত্রী হয়েও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীর চর্চাকেন্দ্র এবং কলা ভবনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন মিনারা বেগম৷ তবে সেটিই তাঁর একমাত্র প্রশিক্ষণ নয়, বরং সেটি ছিল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির কেবল শুরু৷ এরপর দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধ চালনার জন্য আরো বিভিন্ন জায়গায় অস্ত্র চালনা, গেরিলা এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন মিনারা এবং তাঁর সঙ্গীরা৷
২৫শে মার্চের কালো রাতে পাক বাহিনীর নৃশংসতা ও গণহত্যার কথা স্মরণ করে তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘২৫শে মার্চ রাতে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় ছিলাম৷ সেখানে কালোরাত্রির হত্যাযজ্ঞের ঘটনা আমার নিজের চোখে দেখা৷ রাত বারোটায় চারিদিকে মুহুর্মুহু গুলিতে প্রকম্পিত অবস্থা৷ আমি এবং আমার বোনের ছেলে একটু সাহসী ছিলাম৷ আমরা ক্রলিং করে করে বাসার মধ্যে চলাফেরা করতাম এবং জানালা দিয়ে বাইরের ঘটনা উঁকি দিয়ে দেখছিলাম৷ ঘরের মধ্যে গুলি এসে মাথায় লাগার, শরীরে লাগার ভয় ছিল৷ মধ্যরাতে গোলাগুলি কিছুটা কমে আসার পর জানালা দিয়ে দেখলাম, সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের, যেটা তখন ইকবাল হল ছিল, পেছনে খেলার মাঠে লাশের স্তূপ৷ খড়ের পালা যেমন হয়, তেমনভাবে লাশ এনে এনে জমা করা হয়েছে৷ ২৭শে মার্চ সান্ধ্যআইন শিথিল করা হলে আমরা রূপগঞ্জ গ্রামে চলে যায়৷ সেখানে আমি এবং ফোরকান বেগম মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ শুরু করি৷ সেসময় ঢাকা নগরীকে আক্রমণ করতে হলে রূপগঞ্জ দিয়েই মুক্তিযোদ্ধাদের আসতে হতো৷ আমরা দু'জন তখন মুক্তিযোদ্ধাদের আসা-যাওয়া, যাত্রার পরিকল্পনা, থাকা-খাওয়া সবকিছুর ব্যবস্থা করতে থাকি৷ এছাড়া সেখানে মেয়েদের এবং ছোট বাচ্চাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে তথ্য সরবরাহের কাজ করাতাম৷ বিশেষ করে মেয়েদের উপর যেহেতু অত্যাচার করা হতো তাই শিশুদের এই কাজে লাগানো হয়৷''
তবে কিছুদিন পর বাহকের হাতে পাঠানো চিঠি মারফত নেতৃবৃন্দের নির্দেশ পেলেন ঐ এলাকা ছেড়ে ভারতের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেওয়ার৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘ওখানে আমরা যখন কাজ করছি তখন মণি ভাই আমাদের চিঠি পাঠান যে, সেখানে আর থাকা নিরাপদ নয়৷ তোমাদের কাজের কথা জানাজানি হয়ে গেছে৷ তাই পত্রবাহকের সাথেই চলে আসবে৷ নাসির মামার হাতে চিঠি পেয়ে তাঁর সাথেই আমি এবং ফোরকান বেগম আগরতলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি৷ আমরা নরসিংদীর কাছে পাক সেনাদের সামনে পড়ে যাই৷ কিছুক্ষণ পরেই সেখানে গ্রাম পুড়ানোর জন্য যাচ্ছিল পাক সেনারা৷ এর মধ্যেই সেখানে অনেক কৌশল করে রক্ষা পেয়ে যাই৷ সেসময়ও আমাদের ব্যাগে ছোট আকারের গ্রেনেড ছিল৷ আমরা তো আগেই অস্ত্র চালনা শিখেছিলাম৷''
করিমপুর হয়ে কসবা ভিটগড়ে যান মিনারা বেগম এবং তাঁর সঙ্গীরা৷ ভিটগড়ে ভুল করে শান্তিবাহিনীর প্রধানের বাড়িতে গিয়ে ওঠার ঘটনা সম্পর্কে মিনারা বেগম জানান, ‘‘আমরা সেখানে আওয়ামী লীগের এক লোকের বাড়িতে আমাদের আশ্রয় নেওয়ার কথা৷ কিন্তু অন্ধকার রাতে আমরা গিয়ে উঠি শান্তিবাহিনীর প্রধান কালু সর্দারের বাড়িতে৷ আমরা ঘটনা বোঝার পর নিজেদের রক্ষার জন্য বুদ্ধি খাটালাম৷ কালু সর্দারের নাতনি রোজী এবং পরিবারের অন্যান্য সবার সাথে মিশে গেলাম৷ এমনকি আশেপাশের বাড়িগুলোর ঝি-বউদের সাথেও খাতির জমালাম৷ এক পর্যায়ে উনাকে বুঝালাম যে, আপনি যে আমাদের মা-বোনদের পাক সেনাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন, এটা কি ঠিক হচ্ছে? তিনি আমাদের বললেন যে, ‘না, মা আমি শুধুমাত্র গ্রাম বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করছি৷' এমনকি তিনি তাঁর ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে পাঠানোর কথা দিয়েছিলেন এবং তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন৷ পরে তাঁর দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে৷ তারা আমাদের সাথে আগরতলায় গিয়ে দেখা করেছিল৷''
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: জাহিদুল হক