রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সিমের মেলা
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) আইন অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি মোবাইল ফোনের সার্বোচ্চ ১৫টি সিম (সাবসক্রাইবার আইডেন্টিফিকেশন মডিউল) কিনতে পারেন। আর কর্পোরেট গ্রাহকেরা কিনতে পারেন তাদের যত প্রয়োজন তত।
বিটিআরসি জানায়, বাংলাদেশি নাগরিকদের এই সিম কেনার জন্য প্রয়োজন হয় ন্যাশনাল আইডি কার্ড (এনআইডি) অথবা নাগরিকত্ব প্রমাণ করে এমন কোনো ডকুমেন্ট। গ্রাহকের আঙ্গুলের ছাপ জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডারের এনআইডি ডাটাবেইজের সঙ্গে মিলিয়ে গ্রাহকের পরিচিতি নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশের সব গ্রাহকের বায়োমেট্রিক রেজিষ্ট্রেশন আছে। ফলে প্রশ্ন জাগতেই পারে বাংলাদেশে অবৈধ সিম কার্ড কীভাবে সংগ্রহ করা যায়?
টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ আলম যে সিম ব্যবহার করেন সেটির নিবন্ধন একজন বাংলাদেশির নামে৷ আলম জানান, ‘‘ক্যাম্পে বিভিন্ন মোবাইল কোম্পনির ডিলাররা গাড়ি নিয়ে আসেন। রীতিমত মাইকে ঘোষণা দিয়ে সিম বিক্রির মেলা বসে। য়। তবে কোনো সিমই রোহিঙ্গাদের নামে নয়। আমাদেরতো সরাসরি সিম কেনার সুযোগ নেই৷''
কুতুপালং ক্যাম্পের আরেকজন রোহিঙ্গা আমির হোসেন বলেন, ''আমার সিমটি আমি এখানকার এক বাংলাদেশি বন্ধুর মাধ্যমে নিয়েছি। তার নামেই সে আমাকে সিমটি কিনে দিয়েছে।''
এই দুই রোহিঙ্গার ভাষ্য, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রাপ্তবয়স্ক বেশিরভাগের হাতেই মোবাইল আছে। কক্সবাজারের ৩৩টি ক্যাম্পে এখন প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছেন৷
বিভিন্ন মেবাইল ফোন কোম্পনির স্থানীয় ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা কৌশলে সিম বিক্রি করেন। একজন গ্রাহক যে বৈধভাবে সর্বোচ্চ ১৫টি সিম কিনতে পারেন সেই সুযোগ নেয় তারা। বাংলাদেশের কারো নামে নিবন্ধন দেখিয়ে সেসব সিম একটু বেশি দামে রোহিঙ্গাদের কাছে বিক্রি করে। এছাড়া কর্পোরেট সিম বিক্রির সুযোগও নেয় মোবাইল কোম্পানিগুলো৷
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় মোবাইল ফোন অপারেটর রবির ডিলার মাত্র একজন। কিন্তু সেখানে অনুমোদিত খুচরা বিক্রেতা আছেন ১৮৯ জন। এভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকার উপজেলাগুলোতে বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটরের অস্বাভাবিক সংখ্যায় খুচরা বিক্রেতা রয়েছে৷
উখিয়ায় রবির ডিলার ইমরান আহমেদ বলেন, ‘‘রিটেইলাররা স্থানীয়দের কাছ থেকে সিম ম্যানেজ করে রোহিঙ্গাদের কাছে বিক্রি করে থাকতে পারেন, আমরা করি না। আর স্থানীয় লোকজনও নিজেদের নামে সিম তুলে রোহিঙ্গাদের কাছে বিক্রি করেন৷''
অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিকেরা যখন সিম কেনন তখন তাদের আঙুলের ছাপ নেওয়ার সময় কৌশলে একাধিক সিমের রেজিষ্ট্রেশন করিয়ে নেন রিটেইলাররা। পরে তারা ওই সিম অন্যের কাছে বেশি দামে বিক্রি করেন৷ কেউ চাইলে একটি এসএমএস পাঠিয়ে যাচাই করতে পারেন তার এনআইডির বিপরীতে কতটি সিমের রেজিস্ট্রশন রয়েছে৷
অবৈধভাবে সিম বিক্রির অভিযোগের বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (এমটব) মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এস এম ফরহাদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা কিভাবে নিবন্ধিত সিম পেয়েছে সে ব্যপারে আমাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য নেই। যাদের নামে ওইসব সিম নিবন্ধন করা আছে তাদের খুঁজে বের করলেই হয়ত এর জবাব পাওয়া যাবে।''
বিটিআরসির সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) জাকির হোসেন খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ''প্রতিটি অবৈধ সিমের জন্য ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে। আর কেউ যদি নিজের নামের সিম অন্যকে ব্যবহার করতে দেন তাহলে ওই সিম যার নামে দায়দায়িত্বও তার। এজন্য আলদাভাবে কোনো শাস্তির বিধান নেই৷''
‘‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আমরা মোবাইল নেটওয়ার্ক পুরো বন্ধ করছি না। আমরা কৌশলগত কারণে রোহিঙ্গাদের মোবাইল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি৷ ওখানে যাতে নতুন সিম বিক্রি না হয় সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তাদের হাতে যে সিম আছে সেগুলোর ব্যাপারে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করছে। অপারেটররাই এখন ওইসব সিমের ব্যাপারে তাদের অবস্থান জানাবে৷''
জাকির জানান, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় বিকেল ৫টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত থ্রি ও ফোরজি সেবা বন্ধ করে দিয়ে টুজি চালু রাখা হবে৷ তবে অন্য সময় নেটওয়ার্ক স্বাভাবিকভাবে কাজ করবে৷
বিটিআরসির হিসেব অনুযায়ী, সিম বিক্রির হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন গ্রাহক রয়েছে ১৬ কোটি ১০ লাখ। কত সংখ্যক মানুষের হাতে এসব সিম রয়েছে সেই হিসেব কারো কাছে না থাকলেও অপারেটরার বলছেন তা নয় থেকে ১০ কোটি হতে পারে।