লক্ষ্যহীন বিশ্বকাপের অপেক্ষায়
২১ অক্টোবর ২০২২এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথাই ধরুন না৷ বাংলাদেশের জন্য এই টুর্নামেন্টের দখিন দুয়ারে খিল পড়েছে সেই কবে! আকাশজোড়া মেঘ কত কাল! বসন্তকে অনন্ত অপেক্ষায় রেখেছে অন্তহীন পাতা ঝরার দিন৷ কম তো নয়- ১৫ বছর! ২০০৭ থেকে ২০২২৷
এর মধ্যে কত কিছু হয়ে গেল৷ কত কিছু বদলে গেল সময়ের সম্মোহনে৷ যে শিশুটি সেদিন স্বরে অ, স্বরে আ -- আজ সে ভার্সিটি পড়ুয়া৷ অঙ্কুরোদগমের নুপূরে বেজে উঠেছিল যে প্রাণ, সেখানে আজ দিগন্তজোড়া সবুজের উল্লাস৷ বিবর্তনের স্রোতে ক্রিকেটও কেমন বদলে গেল! টেস্টের আভিজাত্য, ওয়ানডের গৌরব পেরিয়ে এখন টি-টোয়েন্টির রাজত্ব৷ কুড়ি-বিশের দৌরাত্ম্য৷
অথচ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে আর একটি জয়ও তো পায়নি বাংলাদেশ!
যদিও ২০০৭ সালে টুর্নামেন্টের পথচলার শুরুতে শুরুর ম্যাচেই ছিল লাল-সবুজের দাপট৷ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দেয় দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলে৷ এরপর একে একে আরো ছয় বিশ্বকাপ এলো-গেল৷ ২০০৯৷ ২০১০৷ ২০১২৷ ২০১৪৷ ২০১৬৷ ২০২১৷ মূল পর্বে আর একটি ম্যাচও জিততে পারেনি বাংলাদেশ৷ বরং দেশের মাটিতে হংকংয়ের কাছেও হেরেছে৷ গতবার হেরেছে স্কটল্যান্ডের কাছেও৷
কুড়ি-বিশের বিশ্বকাপের রেকর্ড তাই বিব্রত এক তাড়া কাগজ হয়ে তাড়িয়ে বেড়ায় বাংলাদেশকে৷
এবার সে রেকর্ডে পরিবর্তনের সম্ভাবনা কতটা? বাংলাদেশের ‘ইনটেন্ট’ কী, সেটি সবাই জানি৷ প্রশ্ন হচ্ছে, কাঙ্খিত সেই ‘ইমপ্যাক্ট’ কি রাখতে পারবে মাঠের ক্রিকেটে?
এ দেশের ক্রিকেটে মাঝেমধ্যে কিছু শব্দের আমদানি হয়৷ মূলত বিদেশি কোচের সৌজন্যে৷ শ্রীধরন শ্রীরামের কারণে যেমন ‘ইনটেন্ট’ আর ‘ইমপ্যাক্ট’ ঢুকে গেছে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি অভিধানে৷ অর্থাৎ সাধারণে বোঝার মতো করে বললে, ইনটেন্ট মানে ইচ্ছে আর ইমপ্যাক্ট অর্থ প্রভাব৷
তা বলুন তো দেখি, টি-টোয়েন্টির প্রথা মেনে খুনে ব্যাটিং কিংবা চাতুর্যময় বোলিংয়ের ইচ্ছে কার না আছে! তবে সেটি যথাযথভাবে করতে পারলেই না প্রভাব থাকবে! বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ঠিক এই জায়গাতেই ব্যর্থ৷ কেন?
জাতীয় দলের সাবেক কোচ সারোয়ার ইমরান এক্ষেত্রে দেশের ক্রিকেটে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে খেলা কম হওয়াকেই মূল দায় দেন, ‘‘একটা জিনিস খেয়াল করে দেখবেন, আমরা ওয়ানডে ভালো খেলি৷ কারণ, সারা দেশে ওয়ানডে খেলা হয়৷ আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা ৫০ ওভারের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ৷ এটা খুব প্রতিন্দ্বন্দ্বিতাপূর্ণ৷ স্ট্যান্ডার্ড অন্য যে কোনো প্রতিযোগিতার চেয়ে বেশি৷ টি-টোয়েন্টিতে আমরা একটা বিপিএল খেলি, যেখানে দেশের ক্রিকেটাররা লিডিং পার্ট নিতে পারে না; ওটা বিদেশিরাই নেয়৷ বিপিএলে পাশাপাশি হয়তমাঝেমধ্যে প্রিমিয়ার লিগের আগে একটা ওয়ার্ম আপ টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতায় খেলি৷ পাশের দেশ ভারতে দেখবেন, প্রতিটি রাজ্যেই বিপিএলের মতো টুর্নামেন্ট হচ্ছে৷ টি-টোয়েন্টিতে যদি আমরা ভালো করতে চাই, তাহলে টুর্নামেন্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে৷ আমাদের লোকালি টি-টোয়েন্টি খেলতে হবে; বিপিএলও খেলতে হবে৷’’
সারোয়ার ইমরানের কাছে টি-টোয়েন্টির বদলে যাওয়া টেকনিকও গুরুত্বপূর্ণ, ‘‘টি-টোয়েন্টির স্ট্যান্স, ব্যাকলিফট আলাদা৷ এগুলো এমসিসির ধারা মতো নয়৷ টেকনিক অনেক বদলে গেছে৷ টি-টোয়েন্টিতে স্ট্যান্স ওপেন থাকে; জোরে মারার জন্য বডি ওয়েট ট্র্যান্সফার করতে হয়৷ বলের পেছনে ব্যালেন্স পজিশনে দাঁড়াতে হয় ৩৬০ ডিগ্রিতে খেলার মতো৷ বক্সারের স্ট্যান্সের মতো৷ আমাদের দেশে এ জিনিসগুলো চালু হয়েছে; তবে খুব কম৷ অনেককে বলতে শুনি, আমাদের গড়ন ছোটখাটো বলে এটা খুব ডিসঅ্যাডভানটেজ৷ এগুলো ভুল কথা৷ একটা সাড়ে পাঁচ আউন্সের বল মারার জন্য সেরকম কিছু লাগে না৷ টি-টোয়েন্টিতে ভালো করতে হলে আমাদের টেকনিকে উন্নতি করতে হবে৷’’
জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার তুষার ইমরানের কাছে বারবার কোচ পরিবর্তনকে ভালো না করার কারণ মনে হয়৷ আর জাতীয় দলের খেলার অ্যাপ্রোচেও বিভ্রান্তি দেখেন তিনি৷ এখানে পাকিস্তানকে বরং অনুসরণের পরামর্শ তার, ‘‘আমাদের একেকজন কোচ একেক থিওরি নিয়ে আসেন৷ আমার মনে হয়, পাকিস্তানের কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি৷ ওদের উপরের দিকে ব্যাটসম্যানরা পাওয়ার ক্রিকেট খেলে না; ক্যালকুলেটিভ ক্রিকেট খেলে৷ বাবর আজম কিংবা রিজওয়ানের একজন ১৫ নম্বর ওভার পর্যন্ত থাকে৷ এটা যদি আমরা করতে পারি, উপরের দিকের একজন ব্যাটসম্যান এভাবে খেলতে পারলে পুরো দলের ইনিংসটা বদলে যাবে৷ ত্রিদেশীয় সিরিজে যেটা সাকিব করার চেষ্টা করেছে৷ এ কাজটা প্রথম তিন ব্যাটসম্যানের কেউ করতে পারলে ভালো হবে৷’’
তাহলে এ বিশ্বকাপে দলের কাছে প্রত্যাশা কী? তুষার ইমরান টেনে আনেন বিসিবি প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপনকে, ‘‘প্রত্যাশা তো আমরা কী, কারোই নেই৷ বোর্ড প্রেসিডেন্টই তো বলেছেন, এই বিশ্বকাপ ওনার টার্গেট না৷ পরের বিশ্বকাপ টার্গেট৷ আমার প্রত্যাশা থাকবে, এই বিশ্বকাপটা যেন ভালোভাবে শেষ করতে পারি৷ টি-টোয়েন্টিতে আমরা ভালো খেলতে পারি, সেটা যেন প্রমাণ করতে পারি৷’’
সে প্রত্যাশা পূরণ হবার কোনো সম্ভাবনা কি দেখেন বাংলাদেশের জার্সিতে পাঁচ টেস্ট ও ৪১ ওয়ানডে খেলা তুষার ইমরান, ‘‘চান্স খুব কম৷ এই বিশ্বকাপে যদি দুটো ম্যাচ জিতি, তাহলেও হয়ত পরের পর্বে যেতে পারবো না৷ তবে প্রথম পর্বে দেখেছি ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কার মতো দলগুলোও হারছে ছোট দলের কাছে৷ এখান থেকে আমরা অনুপ্রেরণা নিতে পারি৷ কারণ টি-টোয়েন্টিতে ছোট দল বলে কিছু নেই৷ আমাদের তাই ভালোভাবে পরিকল্পনা করে মাঠে নামা উচিত৷’’
বাংলাদেশ ক্রিকেটে এই পরিকল্পনার যে বড্ড অভাব, সেটি স্পষ্ট৷ টি-টোয়েন্টিতে তাই এলেবেলে দল হয়ে থাকে বাংলাদেশ৷ বিশ্বকাপে এবারও জয় পাবে না, হামাগুড়ি দেয়া সে সংশয়টা বুনো জন্তুর মতো হাঁ করে থাকে৷
এক দিক দিয়ে বাংলাদেশের বড় বাঁচোয়া৷ এবারের বিশ্বকাপের প্রথম পর্ব খেলতে হয়নি৷ গতবার সেখানে খেলে প্রথম ম্যাচেই স্কটল্যান্ডের কাছে হার; এরপর কোনোরকমে মূল পর্বে ওঠা৷ এবার প্রাথমিক পর্ব খেললে মূল পর্বে যেতে পারতো বাংলাদেশ, এমন বিশ্বাসের পালে হাওয়া নেই খুব একটা৷
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ বোধকরি এ জায়গাতেই৷ আমজনতার ভালোবাসার সমুদ্র শুকিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ৷ ক্রিকেটের প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন তারা দিনের পর দিন; প্রতি দিন৷ কিন্তু প্রতিদান সামান্য৷ এভাবে আর কত!
এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে তাই ভালো করতেই হবে৷ বিসিবি প্রেসিডেন্ট যতই ২০২৪-কে পাখির চোখ করে দায়মুক্তি নিন, কোচ-ক্যাপ্টেন পরিবর্তনে দায় সারেন; বিদেশি কোচরা যতই বাংলাদেশকে গিনিপিগ বানাক, কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ নিয়ে চলে যাক - মাঠে তো শেষ পর্যন্ত খেলবেন ১১ জন ক্রিকেটযোদ্ধা, যাদের গায়ে থাকবে লাল-সবুজ৷ হৃদয়ে থাকবে এই দুঃখী মানচিত্রের নিত্য টানাপড়েনে থাকা মানুষগুলো৷ তাদের জন্যও কি সবটুকু নিংড়ে দেবার সংকল্প নিয়ে মাঠে নামবেন না সাকিব-লিটন-তাসকিন-মুস্তাফিজরা?
তাহলেই তো ত্রস্ত হরিণীর পায়ে পায়ে পালিয়ে বেড়ানো সাহসটা ফেরে আবার৷ ফেরে বিশ্বাস৷ ফেরে আস্থা৷ তাহলেই তো খুলে যাবে দখিন দুয়ার৷ উড়ে যাবে সংশয়ের মেঘমালা৷ পাতা ঝরার কাল পেরিয়ে আসবে বসন্তদিন৷
বাংলাদেশের জন্য টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কি আসবে অমন এক দিন? এক দিন স্বপ্নের দিন?