লালনের গান ও শিল্পের স্বাধীনতার পক্ষে কথা ও গান
মরমী শিল্পী লালনের গানের দুটি লাইন লেখার কারণে গ্রেপ্তারের ঘটনা লেখা এবং শিল্পচর্চার স্বাধীনতার বিষয়টিকে আবার প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে৷ ছবিঘরে থাকছে এ বিষয়ে শিল্পী এবং শিল্পসংশ্লিষ্টদের প্রতিক্রিয়া...
লালন ফকির জাত-পাতের ঊর্ধ্বে, তার সৃষ্টিকর্ম নিয়ে তর্ক-বিতর্কের যুক্তি নেই: ফরিদা পারভীন, লালনসংগীত শিল্পী
আমি লালন সাঁইজির অনেক গান করেছি৷ তার গানের প্রচার ও প্রসারের চেষ্টা করি৷ লালনের অনেক গানে প্রেমতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, আল্লাহ-নবী, রাধা-কৃষ্ণ তত্ত্ব আছে৷ এর মধ্যে ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’ ৩০০ বছর আগে রচনা করা৷ কখনোই গানটি নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি, এখন কেন হচ্ছে? লালন ফকির কিন্তু জাত-পাতের অনেক ঊর্ধ্বে৷ তার সৃষ্টিকর্ম নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করার কোনো যুক্তি নেই৷
সংস্কৃতি ও ধর্মকে গুলিয়ে ফেলার চেষ্টা মোটেও কাম্য নয়: সুজিত মোস্তফা, নজরুলসংগীত শিল্পী
বাংলাদেশের শিল্পীদের অবস্থা বিভিন্ন কারণে এমনিতেই নাজুক৷ মৌলিক সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের কর্পোরেট খাত, কিংবা সরকারিভাবে তেমন সমর্থন দেখি না৷ এরমধ্যে কিছু অতি উৎসাহী লোক সবকিছুতে ধর্মকে টেনে আনে৷ ধর্ম এত ঠুনকো নয় যে, একটি কথাতেই গুঁড়িয়ে যাবে৷ সংস্কৃতি ও ধর্মকে গুলিয়ে ফেলার চেষ্টা মোটেও কাম্য নয়৷ সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মীদের আক্রমণ করাও দুর্ভাগ্যজনক৷
গণতান্ত্রিক দেশে কারো কণ্ঠরোধ করা সুখকর বিষয় নয়: কিরণ চন্দ্র রায়, লোকসংগীত শিল্পী
লালন সাধকের গান যুগ যুগ ধরে চলে আসছে৷ এগুলো নতুন নয়৷ এরমধ্যে ‘সব লোকে কয়’ গানটি সমাজ ও মানুষের বোধ জাগ্রত করার নিমিত্তে লেখা৷ এটা নিয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া যায় কিনা আমার বোধে ধরে না৷ এখন এসব নিয়ে আপত্তি তোলা মানে সাংস্কৃতিক দরজা বন্ধ করে দেওয়ার অপচেষ্টা৷ এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে আমাদের শিল্পীদের ওপর স্বাধীনভাবে গাইতে না পারার খড়গ ভর করে আছে৷ গণতান্ত্রিক দেশে কারও কণ্ঠরোধ করা সুখকর বিষয় নয়৷
যে-কোনো মানবতাবাদী মানুষ লালনে অনুপ্রাণিত, তার সৃষ্টি নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই: ফজলুর রহমান বাবু, অভিনেতা
‘সব লোকে কয়’ গানটি ছোটবেলা থেকেই শুনছি৷ এটি মোটেও ধর্মকে অবমাননা করে না৷ বরং মানবতার পক্ষে কথা বলেছেন লালন৷ সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানুষ এবং মানুষ পরিচয়ই আমাদের প্রথম পরিচয়, তিনি সেটাই তুলে ধরেছেন৷ আমাদের জাতীয়র কবিতায় বলা আছে– ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান৷’ নজরুল, রবীন্দ্রনাথ কিংবা যেকোনও মানবতাবাদী মানুষ লালনে অনুপ্রাণিত৷ তার সৃষ্টি নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই৷
কারো গানের অনুরাগী তার মনের ভাব প্রকাশ করলে সেটি নিয়ে বিতর্ক হওয়া উচিত নয়: ঐশী, কণ্ঠশিল্পী
আমি লালনের গানের একজন অনুরাগী৷ লালনের গান শুনতে ও গাইতে ভালো লাগে৷ আমার মতে, গান তো গানই৷ গান বিনোদনের খোরাক দেয়, মনে শান্তি জোগায়৷ বিশেষ করে লালনের গানের কথা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে না৷ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু৷ একই কথাকে আমরা অনেকভাবে গ্রহণ করতে পারি৷ লালন কিংবা অন্য কারও গানের অনুরাগী হয়ে কেউ যদি মনের ভাব প্রকাশ করে, আমার মনে হয় না সেটি নিয়ে বিতর্ক হওয়া উচিত৷
মানুষের সাংস্কৃতিক জানাশোনা না থাকলে লালনের গান, নজরুলের কবিতা, কোনোকিছুর মর্মার্থই বুঝবে না: আব্দুন নূর তুষার, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
মানুষের সাংস্কৃতিক জানাশোনা না থাকলে লালনের গান হোক আর নজরুলের কবিতা, সেই মর্মার্থ বুঝবে না৷ এজন্যই উন্নয়ন মানে পিলার না৷ গোয়ালঘরে এসি লাগালেও ওখানে গরু গোবরই উৎপাদন করবে৷
‘গ্রেফতার করো আমাকেও’
সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেক শিল্পী সামাজিক মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷ ‘গ্রেফতার করো আমাকেও’ কথাটি জুড়ে দিয়েছেন তারা৷ গীতিকবি হাসান মতিউর রহমানের মতে, ‘সব লোকে কয়’ হলো লালন সাঁইজির একটি মানবধর্ম কবিতা৷ অভিনেত্রী রুনা খান দুটি স্ট্যাটাসের সঙ্গে একমত পোষণ করে সেগুলো শেয়ার দিয়েছেন৷ আনান বাউল প্রতিবাদ জানিয়ে ছড়া লিখেছেন, ‘খুন করবি? কর! পাই না কো ডর! সত্য কথা বলেই মরবো না হবো নড়চড়৷’
শহীদ মিনারে লালন সংগীতের আসর
‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ প্রতিপাদ্য নিয়ে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লালন সংগীতের আসর বসায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট৷ সেখানে লালনের বেশ কিছু গান পরিবেশন করেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পীরা৷ এর আগে প্রতিবাদ জানিয়ে ৩০ এপ্রিল বগুড়া উদীচী কার্যালয়ে লালন সন্ধ্যা আয়োজন করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর বগুড়া জেলা সংসদ৷