লেবাননে সিরীয় শরণার্থীদের অসহায় জীবন
১ জুন ২০২৩মে মাসের এক সকালে লেবাননের ত্রিপোলিতে যাচ্ছিলেন মৌয়াদ এস (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, তাই ছদ্মনাম ব্যবহার করা হলো)৷ সেনাবাহিনীর এক চেকপোস্টের সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলেন মৌয়াদ৷ মনে ভয়- গাড়িতে গেলে সেনাসদস্যরা যদি গ্রেপ্তার করে! আগে বেশ কয়েকবার অন্য সিরীয়দের সঙ্গে এমনই হয়েছে ৷ গাড়ি বা মোটর সাইকেল থেকে নামিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের৷ কিন্তু এবার মৌয়াদ হেঁটে যেতে গিয়েও বাধা পেলেন৷ সেনাসদস্যরা ডেকে নিয়ে বৈধ কাগজ দেখাতে বললেন৷ কোনো কাগজ ছিল না সঙ্গে৷ ফলে সঙ্গে সঙ্গেই আটক করা হলো মৌয়াদকে৷
বার বার অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও সেনা সদস্যরা তাকে ছাড়েননি৷ পাশের আরেক চেকপোস্টে নিয়ে আটকে রাখা হয় সারারাত৷ পরের দিন খুব ভোরে কয়েকজন লোক এসে ধরে নিয়ে যায় তাকে৷ গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সিরিয়া সংলগ্ন লেবানন সীমান্তে৷ সেখানে এক ভবনে আটকে রাখা হয় মৌয়াদকে৷
কারা আটক করে রেখেছিল তাকে? তাদের পরিচয় এখনো জানেন না মৌয়াদ৷ তাকে সিরিয়ায় ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল তারা৷ সিরিয়ায় ফেরা মানেই বাশার আল আসাদের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর কাছে ধরা পড়া এবং ধরা পড়া মানেই অকথ্য নির্যাতনের শিকার হওয়া৷
নির্যাতন এড়াতে টাকার বিনিময়ে মুক্ত হতে চাইলেন মৌয়াদ৷ তাতে কাজও হলো৷
তিনদিন পর মোবাইল বিক্রির টাকাসহ মোট ৫৫০ ডলার পাঠালেন মৌয়াদের ভাই৷ সেই ৫৫০ ডলার দিয়ে অবশেষে ছাড়া পেলেন সিরিয়া থেকে লেবাননে আশ্রয় নেয়া ২৫ বছর বয়সি তরুণ মৌয়াদ৷
মৌয়াদের মতো এমন অভিজ্ঞতা আরো অনেকের হয়েছে৷ লেবানন সরকার যখন ঘোষণা করে, ২০১৯ সালের পর সিরিয়া থেকে যারা লেবাননে এসেছেন, তাদের সবাইকে বৈধ কাগজ দেখাতে হবে, কাগজ না থাকলে তাদের ফিরে যেতে হবে নিজ দেশে- সেই থেকে চলছে সিরীয়দের প্রত্যাবাসন৷ গত কয়েক মাসে প্রত্যাবাসনের হার বেশ বেড়েছে৷
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং অ্যাক্সেস সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস (এসিএইচআর)-সহ বেশ কিছু মানবাধিকার সংস্থা বলছে, গত এপ্রিল থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ২০০ থেকে ৮০০-র মতো সিরীয়কে সিরিয়ায় ফেরত পাঠানো হয়েছে৷ তারা অবশ্য এ-ও বলছে যে, সংখ্যাটি ঠিক কিনা তা তারা যাচাই করে দেখেনি৷
সম্প্রতি লেবাননের কয়েকটি পৌরসভা সিরীয়দের ওপর নৈশ আইন জারি করেছে৷ ফলে সেসব এলাকায় দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্তই ঘরের বাইরে যেতে পারেন তারা৷ ধারণা করা হচ্ছে, লেবাননের স্বরা্ষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ঘোষণা পৌর কর্তৃপক্ষকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে৷ মে মাসের শুরুর দিকে এক নির্দেশনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, দেশের যে স্থানে যত সিরীয় আছেন তাদের সবার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে৷
এখানেই শেষ নয়৷ লেবাননের ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন সম্প্রতি ‘সিরীয়দের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত লেবানন' প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছে৷ লেবাননে নানা স্তরে বলাবলি হচ্ছে, সিরীয়রা দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়াচ্ছে, সংখ্যায় বাড়তে বাড়তে তারা পুরো দেশকে দখল করার আশঙ্কাও বাড়াচ্ছে৷ পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত করেছে লেবাননের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী হেক্টর হাজ্জারের এক বক্তব্য৷ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘লেবাননের ডেমোগ্রাফি বিপজ্জনকভাবে বদলাচ্ছে৷ এক সময় এ দেশের মানুষ হয়ত নিজের দেশেই শরণার্থী হয়ে যাবে৷''
হাইনরিশ ব্যোল ফাউন্ডেশনের বৈরুত কার্যালয়ের প্রধান আনা ফ্লাইশার মনে করেন সিরীয়দের নিয়ে লেবাননের পরিস্থিতি এ মুহূর্তে ‘খুবই উত্তেজনাপূর্ণ'৷ ডয়চে ভেলেকে অবশ্য তিনি বলেছেন লেবাননে সিরীয়বিদ্বেষী মনোভাব নতুন কিছু নয়, ‘‘লেবাননে এই সিরীয়বিদ্বেষী মনোভাব অনেক বছর ধরেই চলে আসছে৷ দুটি দেশের অতীত ইতিহাস এতে বড় ভূমিকা রেখেছে৷''
১৯৭৬ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত লেবাননের একটা অংশ ছিল সিরিয়ার দখলে৷ আনা ফ্লাইশার মনে করেন, ওই সময়ের তিক্ত অভিজ্ঞতার গভীর ক্ষত এখনো রয়ে গেছে লেবানিজদের মনে৷
লেবাননে রাজনীতিবিদদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশও সিরীয়বিদ্বেষী৷ মূলত ‘অভিজাত' শ্রেনীর ওই রাজনীতিবিদরা মনে করেন, সিরীয়দের কারণে লেবাননের অথনীতি অতিরিক্ত অনাবশ্যক চাপে পড়ছে৷
আনা ফ্লাইশার মনে করেন, এমন বক্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে আসলে সিরীয়দের স্রেফ বলির পাঁঠা বানানো হচ্ছে৷ তার মতে, সিরীয়দের কারণে লেবানন সরকার বরং অনেক আন্তর্জাতিক অনুদান পাচ্ছে যা ঠিকভাবে কাজে লাগালে অর্থনীতির দুরবস্থা অনেকখানি কাটিয়ে ওঠা যেতো৷
লেবাননের জনসংখ্যা ৫৫ লাখ৷ সিরিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ২০ লাখের মতো সিরীয় সেই দেশে আশ্রয় নিয়েছেন৷ ২০ লাখের মধ্যে মাত্র আট লাখ পাঁচ হাজার সিরীয় কাগজে-কলমে বৈধভাবে লেবাননে বাস করছেন৷
মে মাসে লেবানন এবং লেবাননের বাইরের মোট ২০টি মানবাধিকার সংগঠন সিরীয়দের দেশে ফেরানো বন্ধ করার আহ্বান জানায়৷ লেবানন সরকারের কাছে প্রত্যাবাসন বিষয়ক তথ্যও দাবি করেছে তারা৷ তবে লেবাননের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী হাজ্জার মনে করেন, সেসব তথ্য পরিবেশন লেবাননের জন্য হীতে বিপরীত হতে পারে৷ বিশেষ করে জাতিংসঘের শরণার্থী বিষয়ক সংগঠন ইউএনএইচসি আরকে সিরীয়দের বিষয়ের তথ্য দিতে রাজি নন তিনি৷ হেক্টর হাজ্জার মনে করেন, ইউএনএইচসিআরকে সব তথ্য দিলে নিবন্ধিত সিরীয়দের কোনোদিনই হয়ত সিরিয়ায় ফেরানো যাবে না৷
ডায়ানা হোডালি/ এসিবি