সর্বনাশী মৎসকন্যা
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩রাইন নদীর পারে সুন্দর-শান্ত একটি এলাকা আসমানহাউজেন৷ অধিবাসির সংখ্যা ১ হাজার৷ সেখানকার রাইনের তীর প্রধানত জাহাজ ঘাট বা জেটি হিসেবেই ব্যবহৃত৷ এখান থেকেই ছোটছোট জাহাজ প্রতিদিন পর্যটকদের নিয়ে যায় সেই বিখ্যাত পাথুরে খাড়া পাহাড় দেখাতে যা ‘মৎসকন্যা লোরেলাই' নামে পরিচিত৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বছরে প্রায় ২০ মিলিয়ন বা দু কোটি পর্যটক আসেন এই ‘মিডল রাইন ভ্যালি'-তে, লোরেলাই দেখার জন্য দিনের ভ্রমণে পাড়ি জমান তাঁরা৷ তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই ‘লোরেলাই'-এর গল্প জানেন৷ ২০০২ সাল থেকে লোরেলাই ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত৷
সুর্যস্নাত দিনে জাহাজের ডেকে আইস বা ঠান্ডা পানীয় নিয়ে বসে পর্যটকরা আনন্দময় পরিবেশে উপভোগ করেন ধীরে ধীরে সরে যাওয়া নদীর পারের অপরূপ দৃশ্য৷ পুরোনো দূর্গ বা কাসেল, কাঠের ঘর, সবুজে ঘেরা বনান্তর আর সরস সবুজ আঙ্গুর-খেত বা ভিনিয়ার্ড৷প্রায় দেড় ঘণ্টা নৌ পথ পাড়ি দিয়ে রাইনের বহু মোড়ের মতোই একটি মোড়ে এই পাহাড়৷ এবড়োথেবড়ো- প্রস্তরময়, উঁচু৷ খুব চোখে পড়ার মতো কিছু নয়৷ কিন্তু রাইনের মতোই একে ঘিরে রেখেছে কাল্পনিক, পৌরাণিক এবং কাব্য কাহিনী, যা ছড়িয়ে পড়েছে আটলান্টিক মহাসাগরের ওপার অবধি৷
১৮০১ সালে রোমান্টিক ধারার কবি ও লেখক ক্লেমেন্স ব্রেন্টানো তাঁর বিয়োগান্তক কাহিনীতে লোরেলাইকে এক জাদুকরী নারীর রূপ দিয়েছিলেন৷ এই পাহাড়ের কাছেই ছোট্ট একটি এলাকা বাখারাখে ছিল তাঁর বাস৷ যে কোনো পুরুষই মুগ্ধ হয়ে যেত তাঁর রূপে৷ এক বিশপ তাঁকে মঠে নিয়ে আসার আদেশ করেন৷ যাবার পথেই শেষবারের মতো একবার দেখতে চায় তাঁর ভালবাসার স্থান৷ উঠে আসে এই পাহাড়ে৷ মৃদু গানের সাথে উড়ছিল তাঁর সোনালী চুল৷ তারপর সেই উঁচু থেকেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাইনের বুকে৷
লোকগাঁথায় আছে একটি ভ্রাম্যমাণ জাহাজের নাবিকেরা মুগ্ধ চোখে উপরে তাকিয়ে দেখছিলো দাঁড়িয়ে থাকা ‘লোরেলাই'-এর সেই অপরূপ রূপ৷ পথভ্রষ্ট জাহাজ ধাক্কা খায় পানির তলার কঠিন পাথুরে শিলায়৷ বিধ্বস্ত হয় জাহাজ৷
তবে সাহিত্যে লোরেলাইকে সুপরিচিত করে তোলেন বিখ্যাত কবি, লেখক ও সাংবাদিক হাইনরিশ হাইনে৷ ২০ বছর পর তিনি তাঁর কাব্যে লোরেলাইকে জাদুকরী হিসেবে নয়, তাঁকে তিনি সর্বনাশী মৎসকন্যা হিসেবে তুলে ধরেছেন, যার সাথে গ্রিক পুরাণের কুহকিনীদের কিছুটা মিল রয়েছে৷ তারাওতো অসহায় নাবিকদের ডুবিয়ে মারে৷
৩১ বছর বয়সি নিকো পাঁচ বছর যাবৎ নাবিকের কাজ করছেন৷ কিন্তু ‘লোরেলাই'-এর গান তিনি কখনো শোনেননি৷ রাইন নদীর এই বাঁকে জাহাজ চালানোয় খুব দক্ষতার প্রয়োজন, কারণ, এই মোড় খুব সরু৷ উল্টোদিক থেকে আসা জাহাজ বা অন্য জলযানগুলো সম্পর্কে সজাগ থাকতে হয়৷
ব্রেন্টানোর ভাষায় লোরেলাই এক ‘সর্বনাশী জাদুকরী', কিন্তু নিকো এবং তাঁর পরিবারের জন্য এক আশীর্বাদ, কারণ, প্রতি বছরই তাঁর জাহাজ থাকে পূর্ণ৷