জঙ্গলই যাদের বাড়ি
৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ক্রমেই আরো বেশি মানুষ লোস কোলোরাদোস ন্যাশনাল পার্কের প্রান্তে বাস করছেন, কেননা তাদের অন্য কোথাও যাবার জায়গা নেই৷ লুইস অর্তেগাও এখানে বাড়ি বানিয়েছেন, যদিও তিনি জানেন এ কাজ বেআইনি৷ কী করবেন, শহরের কেন্দ্রে বাড়ি পাওয়া ভার, ভাড়াও আবার বেশি৷
লুইস এদিক সেদিক ছোটখাট কাজ করে সংসার চালান৷ এবার তাঁর পরিবারের মানুষজনের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে৷ লুইস বলেন, ''আমি এখানে বাড়ি তৈরি করছি যাতে আমার ছেলে-মেয়েদের একটা ভবিষ্যৎ থাকে৷ আমার তিন সন্তান; আর আছেন আমার স্ত্রী, আমার ভাই-এর স্ত্রী, আমরা একটা বড় পরিবার৷ আমি আমার পরিবারের জন্য একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ চাই৷''
গত ৫০ বছর ধরে কলম্বিয়ায় সরকার, মাদক পাচারকারী, বামপন্থি আর দক্ষিণপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির মধ্যে রক্তাক্ত সংঘাত চলেছে৷ অন্য অনেকের মতো লুইস ও তাঁর পরিবার সেই সংঘাতের হাত থেকে বাঁচার জন্য পালিয়েছেন৷ এবার একটা বাড়ি পেয়ে সকলেই খুশি৷ লুইসের বক্তব্য, ''আমরা এখানে নিরাপদ; আগে পাহাড়ে যা ছিলাম, তার চেয়ে বেশি নিরাপদ৷ এখানে আমরা গ্রামের ভিতরে না হলেও, গাঁয়ের কাছাকাছি থাকি; নিজেদের অন্তত নিরাপদ বোধ করি৷''
সুরক্ষা যাদের কাজ
রোঁদে বেরিয়েছেন পার্কের কর্মীরা৷ তবে অকারণে লোকজনকে পার্ক থেকে বের করে দেন না তাঁরা৷ লুইস অর্তেগা অন্যত্র যেতে রাজি ছিলেন, যদি অন্যত্র এর চেয়ে ভালো একটা বাড়ি পান৷ কিন্তু তার জন্য অনেক টাকা চাই৷ তাহলে কার মূল্য বেশি: মানুষ না জীবজন্তুর? লোস কোলোরাদোস ন্যাশনাল পার্কের কর্মী হর্খে ফেরার বলেন, ''আমাদের সত্যিই উভয়সংকট৷ সেই কারণে আমরা আপনাদের সঙ্গে মিলে একটা সমাধান বার করার চেষ্টা করছি৷ একটি সমাধান হলো পুনর্বাসন, কিন্তু ক্ষতি যাতে কম হয়, সেটাও আমরা দেখার চেষ্টা করছি; মানুষজনকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, পরিবেশকে বাঁচানো কতটা দরকারি কাজ৷''
ন্যাশনাল পার্ককে বাঁচানোর জন্য অরণ্যরক্ষীরা অপর একটি দীর্ঘমেয়াদি পন্থা নিয়েছেন, যার নাম হল শিক্ষা৷ কাছের শহর থেকে একদল কিশোর-কিশোরী এসেছে, তাদের অনেকেই পার্কের ভিতরকার বস্তিতে থাকে৷ আগে এটা শুধু একটা গিরিসংকট নয়, মালিবু উপজাতির লোকেদের প্রার্থনার জায়গা ছিল৷ মালিবু-রা ছিল প্রকৃতি উপাসক৷ হর্খে ফেরার বললেন, ''আমরা আবার সেই ট্র্যাডিশন চালু করে কিশোর-কিশোরীদের দেখাতে চাই, প্রকৃতি আগে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যাতে ওরা ওদের পূর্বপুরুষদের মতোই প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিতে শেখে৷''
জীবজন্তুরা ছিল ভাইয়ের মতো
সেই পূর্বপুরুষরাই পাথরে এই সব চিহ্ন কুঁদে রেখেছেন৷ কয়েকশ' বছর আগেও মালিবু-রা এখানে বাস করত৷ লোস কোলোরাদোস ন্যাশনাল পার্কের কর্মী ফ্রান্সিস্কো ওসোরিও জানালেন, ''সব জীবজন্তুরা ছিল তাদের ভাইয়ের মতো৷ জাগুয়ার নামের চিতাবাঘটা ছিল এক ধরনের দেবতা৷ সেই দেবতাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এই প্রতীকটা ব্যবহার করা হতো৷'' কিশোর-কিশোরীরা এই প্রথমবার তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে চিনতে শিখছে৷ ফ্রান্সিস্কো ওসোরিও বলেন, ''তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ ভবিষ্যতে জীববিজ্ঞানী হবে, অথবা জীববিজ্ঞান পড়ার সুযোগ পাবে, বলে আমরা আশা করছি৷ আমরা যদি না রাখি, তাহলে এ সবের কোনো অর্থ নেই৷ আমরা এ বিষয়ে যত কম জানব, আমাদের কাছে এর গুরুত্ব ঠিক ততটাই কম হবে৷''
একটা খেলার মধ্যে দিয়ে কিশোর-কিশোরীরা এই সব পুরনো প্রতীক আর ন্যাশনাল পার্কের জন্তুজানোয়ারদের চিনতে শিখছে৷ স্কুলের ছাত্রী মারিয়া হোসে অর্তেগা মেলেন্দে বলে, ''প্রথমবার দেখলে খুব আশ্চর্য লাগে৷ ঠিক বর্ণনা করা যায় না৷ এখানে বেশ কিছু অদ্ভুত জীবজন্তু আছে৷''
একটি জীবের আর দেখা পাওয়া যায় না: সেটি হল জাগুয়ার৷ তবে সে আবার ফিরবে বলে সকলের আশা৷ জাগুয়ারের সম্মানে আর মালিবুদের স্মরণে হর্খে ও তাঁর সহকর্মীরা 'জাগুয়ার ফেস্টিভালের' আয়োজন করেছেন৷ বছরে একবার করে শহরের মানুষরা আসেন, প্রকৃতির কোলে প্রকৃতিকে উদযাপন করতে৷ হর্খে এবং পার্ককর্মীদের পক্ষে এই উৎসব সফল হয়েছে৷ তাঁদের কথায়, ''আমরা খুশি, সুখি৷ আমরা আশা করছিলাম যে অনেকে আসবেন আর ঘটেছেও তাই৷ সেটাই হলো আমাদের নীতির সাফল্য৷ কাজেই আমি খুব খুশি যে এতো কচিকাঁচারা এসেছে৷''
এই সব ছেলে-মেয়েরা যদি পরিবেশ সচেতন হয়ে বড় হয়ে ওঠে, তাহলে তারাই ন্যাশনাল পার্ক রক্ষায় সাহায্য করবে, বলে হর্খের আশা৷