শরণার্থী হোক কিংবা অভিবাসী, পেটাবে কেন?
২৩ অক্টোবর ২০২০বসনিয়ার ভেলিকা ক্লাদুসায় শরণার্থী বিষয়ক সংবাদের অভাব নেই৷ রাস্তায় এদিক-সেদিক তাকলেই দেখবেন দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের নানাদেশের মানুষ ঘুরছে৷ বেশিরভাগই হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটেন সাধারণত৷ নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে চান না৷
আবার দোকানে গেলে দেখবেন কোন এক বসনীয় হয়ত দক্ষিণ এশীয় কারো দিকে বাকা চোখে তাকাচ্ছে, এক তরুণীতো আমার সামনেই এক শরণার্থীকে বললো, ‘‘গোসল করো গিয়ে, তোমার গা থেকে গন্ধ আসছে৷’’ বলে তিনি নাকে রুমাল চাপলেন৷ অথচ এই করোনাকালে একটু আগেও তিনি মাস্ক ছাড়াই বসেছিলেন৷ এমনকি আমার সঙ্গেও প্রথমে কথা বলতে চাইলেন না, এমনভাব করলেন ইংরেজি জানেন না বা বোঝেন না৷ পরে ডয়চে ভেলের সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তার মুখেই ইংরেজিতে খৈ ফুটতে শুরু করেছিল৷
এতটুকু পড়েই বসনীয়দের বিষয়ে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবেন না যেন৷ তাদের আরো অনেক দিক তিনদিনে দেখেছি৷ তার উদাহরণ পাবেন বাকি লেখায়৷ তার আগে শিরোনামটা ‘জাস্টিফাইড’ করে নেই৷
ক্রোয়েশিয়া সীমান্তের একেবারে লাগোয়া শহর ভেলিকা ক্লাদুসা৷ ছোট্ট শহরটির মূল বাসিন্দা হাজার চল্লিশের মতো, তবে সেখানে এখন অন্তত হাজার দুয়েক শরণার্থী এবং অভিবাসী বাস করছেন৷ তাদের লক্ষ্য একটাই৷ যেকোন উপায়ে অবৈধপথে ক্রোয়েশিয়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশ করা৷ এজন্য দলে দলে তারা হঠাৎ হঠাৎ সীমান্তের কোন এক দুর্গম, পাহাড়ি জঙ্গল ঘেরা অংশ দিয়ে ক্রোয়েশিয়া ঢুকতে চান৷ তাদের ভাষায় এটাকে বলে ‘গেম মারা৷’
এরকম এক গেম মারার প্রস্তুতির সংবাদ যখন করছিলাম, তখন এক আফগান হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে তার ফোনে আমাদের কিছু একটা দেখাতে চাইলেন৷
আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম কয়েকজন বাংলাদেশি কাপড় খুলে শরীরে লাঠি পেটার দাগ দেখাচ্ছেন৷ সীমান্তে নাকি তাদের বেধাড়ক পেটানো হয়েছে কিছুক্ষণ আগে৷ সাংবাদিক মন থেকে সন্দেহের সুরে তাকে বললাম, এটা যে কিছুক্ষণ আগের তার প্রমাণ কী? আর ক্রোয়েশিয়া সীমান্তের ঘটনা সেটাই বা কিভাবে বুঝবো?
উর্দু ভাষায় সেই আফগান শরণার্থী জানালেন, আহতদের কয়েকজন হেঁটে হেঁটে ফিরছেন, তবে ধীরগতিতে আসতে হচ্ছে আহত বলে৷ তোমরা গাড়ি নিয়ে একটু সামনে গেলেই তাদের দেখা পাবে৷
দেরি করলাম না, সহকর্মী অনুপমকে নিয়ে বাংলাদেশি শরণার্থীরা যে পাহাড়ে থাকে সেদিকের রাস্তায় ছুটলাম৷ আহরা সেই পথেই ফিরছেন৷ একটু পরে কয়েকজন বাংলাদেশি আমাদের গাড়ি আটকালেন৷ জানালেন, এইমাত্র এক বাংলাদেশি রক্তাক্ত অবস্থায় সীমান্ত থেকে কোনক্রমে ফিরেছেন৷
গাড়ি থামিয়ে তার কাছে গেলাম৷ ডানচোখের উপরের দিকের কোনার চামড়া বেশ খানিকটা কেটে গেছে তার৷ সেলাই ছাড়া এই ক্ষত সারবে না৷ চোখের মধ্যে জমে গেছে রক্ত৷ ঠোটের বামদিকও ফাটা, রক্তাক্ত৷ হাতে, শরীরে শক্ত কিছু দিয়ে পেটানোর দাগ৷
জানতে চাইলাম, কারা পিটিয়েছে৷ উত্তর, ক্রোয়েশিয়ার সীমান্ত পুলিশ৷ কালো পোশাক আর মুখ ঢাকা এই পুলিশ অত্যন্ত বর্বর বলে জানালেন সেখানকার আরো কয়েকজন৷
সত্যি বলতে কী, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত একটি দেশের সীমান্তে মানুষকে এভাবে পেটানো হতে পারে, সেটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছিল৷ আমি জানতে চাইলাম, অন্য শরণার্থীরা মেরে এই হাল করেনিতো৷ এমনওতো হতে পারে নিজেরা নিজেরা মারামারি করে এই অবস্থা হয়েছে!
কিন্তু না, অল্প সময়ের মধ্যে আরো কয়েকজন আহতের কথা জানলাম আমরা৷ পেলাম আরো কয়েকজনের ভাষ্য৷ তাতে এটা স্পষ্ট যে সীমান্তেই ধরে নিয়ে আয়োজন করে আলাদা আলাদাভাবে পেটানো হয় তাদের, এবং সেটা কোন এক বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর কাজ৷
ভেলিকা ক্লাদুসা শহরটা ছোট৷ ডয়চে ভেলের দুই সাংবাদিক যে ক্যামেরা নিয়ে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই তথ্যটা তাই অনেকেই দ্রুত জেনে গিয়েছিল৷ বিশেষ করে পুলিশ এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো আমাদের বেশ গুরুত্বসহকারে নিয়েছিল মনে হয়েছে৷ শরণার্থীদের বক্তব্য অনুযায়ী, আমরা সেখানে যাওয়ার পর অনেক কিছু ঘটেছে যা সাধারণত দেখা যায়না৷ সেই ‘অনেক কিছুর’ একটি হচ্ছে আহত শরণার্থীকে সরিয়ে নিতে কিছুক্ষণের মধ্যে এক অ্যাম্বুলেন্সের আগমন৷
শুধু তাই নয়, বাকি আহত শরণার্থীদের নিয়ে যেতে গাড়ি নিয়ে সেখানে আসে আইওএম৷ প্রতিষ্ঠানটির যে নিরাপত্তা কর্মকর্তা একদিন আগেও কিছুটা কঠিন রূপে আমাদের সঙ্গে কথা বলছিল, তিনি আহতদের বহনকারী গাড়ি থামিয়ে আমাকে বললেন, ‘‘ওদের নিয়ে যাচ্ছি৷ আরো কয়েকজন আহত হয়ে সীমান্ত পড়ে আছে শুনেছি৷ তাদের আনতেও গাড়ি পাঠানো হয়েছে৷ সবাইকে ক্যাম্পে রেখে চিকিৎসা দেয়া হবে৷’’
ক্যাম্প বলতে তিনি বোঝাচ্ছিলেন ‘মিরাল ক্যাম্পের’ কথা৷ আইওএম পরিচালিত এই ক্যাম্পে সাতশ'র মতো শরণার্থী থাকতে পারেন৷ তবে, তারচেয়ে অন্তত দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষ থাকেন পাশের পাহাড়ে এবং একটি পরিত্যক্ত ভবনে৷ সেই ক্যাম্পে গিয়ে দেখলাম, নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনে আহত আরো অনেক শরণার্থীকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে৷ কারো কারো হাত-পাও ভেঙ্গে গেছে৷ একজনের ডানহাততো প্রায় অচল হয়ে গেছে সীমান্তে নিরাপত্তা বাহিনীর কুকুরের কামড়ে৷
সাংবাদিক হিসেবে অনুভূতি না দেখানোরই চেষ্টা করি৷ কিন্তু নিজের দেশের মার খাওয়া মানুষের করুণ মুখ দেখে চোখে জল এসে গেয়েছিল৷ কেন ওদেরকে এভাবে জানোয়ারের মতো পেটানো হবে? কোন দেশের আইন এটা সমর্থন করে? এত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন৷ আর এই লঙ্ঘন ঘটছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বহিঃসীমান্তে৷ ইউরোপীয়দের কাছে এরচেয়ে লজ্জাষ্কর ব্যাপার আর কী হতে পারে! সারা দুনিয়াকে মানবাধিকার শেখানো ইইউ নিজের সীমান্তেই মানবাধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না৷ আমি এটা কোনভাবে আশা করিনি৷
ভেলিকা ক্লাদুসার অনেক সাধারণ মানুষও বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ৷ ডয়চে ভেলে সেখানকার মানুষের কাছে বেশ পরিচিত গণমাধ্যম মনে হল৷ এক সন্ধ্যায় আমাদের পথরোধ করেন এক বসনীয়৷ ভাঙ্গা ভাঙ্গা জার্মান ভাষায় জানান, একটি ভিডিও আমাদের দিতে চান তিনি৷ কারিগরি জটিলতায় সেই ভিডিও তিনি শেষ অবধি দিতে পারেননি৷ তবে তার ভাষ্য অনুযায়ী, ভিডিওটি জঙ্গলে কাঠ কাটার সময় তার বন্ধু ধারন করেছে৷ সেখানে দেখা যাচ্ছিল, ক্রোয়েশিয়া সীমান্তে মার খেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে আছে কিছু মানুষ৷ কারো মুখ ফেটে গেছে, কারো হাতে, পিঠে মারের দাগ৷ ভিডিওটি দেখে আমাদের সঙ্গে থাকা বাংলাদেশিরা কয়েকজনকে আমাদের সামনেই শনাক্ত করতে পেরেছিলেন৷ এই বসনীয় চান, সীমান্তে নির্যাতন বন্ধ হোক৷ তারমতোই আরেকজন বাসার ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের পাসওয়ার্ড মুছে ফেলেছেন যাতে শরণার্থীরা সেটি কোন বাধা ছাড়া ব্যবহার করতে পারেন৷ কেউ কেউ আবার জামাকাপড়, জুতা এনে রাস্তার পাশে রেখে যান৷ সেগুলো বেশ কাজেও লাগে, কারণ সীমান্তে নাকি পেটানোর পর কখনো কখনো প্রায় নগ্ন করে শরণার্থীদের বসনিয়ায় ‘পুশ ব্যাক’ করা হয়৷ তখন এসব কাপড়ই ভরসা৷
যা বলতে চাচ্ছি, তাহচ্ছে বসনিয়া-ক্রোয়েশিয়া সীমান্তে যে বাংলাদেশিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শরণার্থী বা অভিবাসীদের নিয়মিত পেটানো হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই৷ আর এই পেটানো অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে হবে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের এজন্য উদ্যোগ যেমন নিতে হবে, তেমনি যেসব দেশের শরণার্থীরা মার খাচ্ছেন, সেসব দেশের সরকারেরও এটা বন্ধে সোচ্চার হতে হবে৷ তাদের আশ্রয় দেয়া বা না দেয়া একটি দেশের ইচ্ছার ব্যাপার হতে পারে, কিন্তু পেটানো কোনভাবেই সভ্য কোন দেশের কাজ নয়৷ তাই এই অসভ্যতা ইইউকেই দ্রুত বন্ধ করতে হবে৷
১৯ অক্টোবরের ছবিঘরটি দেখুন...