‘‘শরীর-মনের কোনো রোগই ফুঁতে সারে না’’
১৫ নভেম্বর ২০১৯বিশ্বাসের কারণে এক ধরনের স্বস্তি মিলে মাত্র৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, গোটা সমাজে যে অন্ধত্ব বিরাজ করছে, তার কারণেই মানুষ এখনও ঝাড়ফুঁকের আশ্রয় নিচ্ছে৷
ডয়চে ভেলে: একটা সময়ে শিক্ষার হার অনেক কম ছিল, চিকিৎসা ব্যবস্থাও অপ্রতুল ছিল, মানুষের হাতে এখনকার মত প্রযুক্তিও ছিল না, সে কারণে হয়তো ঝাড়ফুঁকে মানুষের অন্ধবিশ্বাসও ছিল? কিন্তু এখনও সেটা কেন এত প্রকট?
ডা. মোহিত কামাল: যারা অতি শিক্ষিত তারাও মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ৷ শিক্ষিত বা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ মানে এই নয় তার সমস্ত অন্ধকার জগৎ আলোকিত হয়ে গেছে৷ মনই কী তাই আমরা চিনি না৷
....কোন চিকিৎসকের কাছে গেলেও তারা মনে করে যে তারা (চিকিৎসকরা) হয়তো কোন খুঁত পায়নি, শারীরিক ত্রুটি পায়নি৷ ‘সাইকো প্যাথোলোজি' বলে একটা বিষয় আছে, মনেও ক্ষত তৈরি হতে পারে৷ সে কারণেও উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও শঙ্কা তৈরি হতে পারে, শারীরিক অনেক উপসর্গও আসতে পারে৷ সেগুলোরও বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা আছে৷ কিছুদিন আগে আমরা একটা জরিপ করেছি, নয় নভেম্বর তার ফলাফল প্রকাশ করেছি৷ সেখানে মেন্টাল হেলথ রিলেটেড ট্রিটমেন্ট গ্যাপ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৯৪ শতাংশ৷ অর্থাৎ ১০০ জন যদি সমস্যায় ভোগে তার ৯৪ জনই চিকিৎসা নিচ্ছে না৷ মাত্র ছয়জন নিচ্ছে৷
শুধু মানসিক সমস্যাতো নয় শারীরিক সমস্যার জন্যেও মানুষ ঝাড় ফুঁকের আশ্রয় নিচ্ছেন৷ সেটা কেন?
শারীরিক সমস্যার অনেকগুলোই মনোজাগতিক, যেগুলোর প্যাথলজি তারা পায় না সেগুলোর জন্যেই সাধারণত মানুষ ঝাড় ফুঁকের আশ্রয় নেয়৷ কিছু অশিক্ষিত মানুষ সেগুলো বেশি করে৷ তবে টিবি, ডায়বেটিস, হৃদরোগ এসব সমস্যায় শিক্ষিতরা ঝাড় ফু্ঁকের আশ্রয় নেয় না৷ মনোজাগতিক সমস্যার জন্যই শিক্ষিতরা ঝাড়ফুঁকে বেশি আশ্রয় নেয়৷... আর অশিক্ষিত কিংবা আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল, যারা গ্রামে বসবাস করে তাদের শারীরিক সমস্যায় ডাক্তার দেখাতে, পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে শহরে যেতে হয়, সেই সামর্থ্য তাদের নেই৷ তারা একটা উপায় (ঝাড়ফুঁক) পেয়েছে৷ হয়তো কারও কাছে শুনেছে ফু দিলে ভাল হয়ে যাবে, সেজন্য সে ঝাপিয়ে পড়ছে৷ এগুলো অন্ধবিশ্বাস, যার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই৷
ফু দিয়ে শারীরিক সমস্যা ভাল হবে এমন কোন রোগ নেই৷ মানসিক বা শারীরিক কোন রোগই ফু দিয়ে ভাল হবে না৷ ...আসলেই আমরা অন্ধত্বে ভুগছি, পুরো প্রক্রিয়াটির মধ্যে এক ধরনের সামাজিক অন্ধত্ব বিরাজ করছে বলে আমি মনে করি৷
চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে না পেরেও অনেকে ঝাড়ফুঁকে আশ্রয় নিচ্ছে৷ তাহলে এর কারণটা অর্থনৈতিক আর মনস্তাত্ত্বিক দুটোই?
হ্যাঁ, অন্যের দ্বারা সে প্রভাবিত হচ্ছে৷ কেউ ভাল হয়েছে সেটা হয়তো সে শুনেছে৷ কিছু কিছু মানসিক রোগ আছে যেমন হিস্টেরিয়ার কথা ধরেন, মনোজাগতিক কষ্টের কারণে তার কোন উপসর্গ যদি আসে, খিঁচুনি আসে তখন শোনা কথার উপর ভর করে সে যাবে৷ তবে হ্যাঁ মনোজাগতিক কোন কষ্টের ঘটনার কথা প্রকাশ করলেও উপসর্গ লাঘব হতে পারে৷ আর তখনই মানুষ মনে করে সে উপকার পেয়ে গেছে৷ হুজুররা পানি পড়া দেয়ার আগে রোগীর কথা শুনে৷ এতে রোগী তার মনের সব কথা হয়তো প্রকাশ করে, তার অবদমিত যে আবেগের যাতনা তৈরি হয় তা থেকে সে মুক্তি পেতে পারে৷ সেই কারণে সে শান্তিও হয়তো পেয়েছে৷ কিন্তু ফু দিলে ভাল হবে, মাইকে ফু দিচ্ছে এবং মানুষ সেই ফু নিয়ে ভাল হচ্ছে এটা অবিশ্বাস্য৷
অনেকের দাবি বা বিশ্বাস যে ঝাড়ফুঁকেই তার রোগ সেরেছে৷ এক্ষেত্রে প্লাসিবো ইফেক্ট কাজ করে কীনা?
প্লাসিবো ইফেক্ট সেখানেই কাজ করবে যেখানে কোন প্যাথলজি নেই৷ যেখানে ফাংশনাল সিস্টেমে সমস্যা রয়েছে, সেখানে প্লাসিবো ইফেক্ট কাজ করতে পারে৷ কিন্তু যেখানে প্যাথলজি আছে সেখানে প্লাসিবো কাজ করবে না, হয়তো একটা স্বস্তি পাবে৷ কারো কাছে সে হয়তো শুনেছে ভাল হয়, এই বিশ্বাসই তার মধ্যে ভাল লাগা ও এক ধরনের স্বস্তি দিবে৷ এর মানে এই নয় যে সে ভাল হয়ে গেছে৷ প্লাসিবো ইফেক্ট আর কিউরিটি (আরোগ্য) দুইটি আলাদা ব্যাপার৷
ধর্মীয় বিশ্বাস, গোঁড়ামিপনার সাথে ঝাড় ফুঁকের সম্পর্ক কতটা?
আমার মতে যারা ধর্মকে ভাল করে জানে না তারাই গোঁড়ামিতে ডুবে থাকে৷... ধর্মকে আগে বুঝতে হবে৷ ধর্ম বলেছে, দোলনা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জ্ঞান নাও৷ ধর্ম জ্ঞানের জন্য চীনেও যেতে বলেছে৷ কিন্তু জ্ঞান নয়, আমরা ডুবে থাকছি অন্ধত্বে৷
এই যে মানুষ চিকিৎসা বিজ্ঞানকে পাশ কাটিয়ে এ ধরনের বিকল্প পন্থা খুঁজে নিচ্ছে এতে কী করনীয় আছে?
এখানে চিকিৎসকদের ভূমিকা আছে৷ গণমাধ্যমের একটি বড় ভূমিকা আছে৷ যারা বিশেষজ্ঞ গণমাধ্যম তাদেরকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে৷ সবাইকে আলোকিত করার জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা পালন করতে হবে৷ ....পরিবারে নিজেদের আলোকিত করতে হবে৷ নিজেকে বোঝাটা সবার জন্য জরুরি৷ ধর্ম, বিজ্ঞান দর্শন সব জায়গায় একই কথা বলা হয়েছে৷ সেই জ্ঞানটা আমরা ব্যবহার করছি না৷ ব্যক্তি আলোকিত হলে এইসব অন্ধত্বও দূর হবে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷