শিশুর সঙ্গে গল্প করুন, বন্ধু হন
২০ জানুয়ারি ২০১৬এই ‘মানুষ' করতে গিয়েই সমস্যার শুরু৷ শুরু বকাবকির, শুরু চর-থাপ্পর, খুন্তির খোঁচা, স্কেলের বাড়ি – এমন হাজারো রকম শাস্তির৷ আমাদের সমাজে হাজারো কাজের চাপ, টাকা-পয়সার টানাটানি, আবার অনেক সময় নেহায়েত অভ্যাসের বশেও বাবা-মা ছেলে-মেয়ের ওপর এমন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন৷ আমি, আপনি বা আমাদের চেনাশোনা অনেকের জীবনেই এমন ঘটনা ঘটেছে, ঘটে চলেছে এখনো৷
প্রশ্ন হলো, এমন শাস্তি কি সত্যিই কাজে দেয়? বাচ্চাকে গায়ের জোরে কি সত্যিই কিছু শেখানো যায়? জোর করে খাওয়ানো, পড়তে বসানো, খেলতে বারণ করা – এ সব আদতে কোনো কাজে আসে কিনা, সে কথা কখনও ভেবে দেখেছেন? আমার তো মনে হয়, এতে সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে, বাড়ে উভয়পক্ষের মানসিক যন্ত্রণা, দ্বন্দ্ব, এমনকি অনেক সময় বিপথগামীও হয়ে যায় ছেলে বা মেয়েটি৷
বাচ্চাদের যত্ন প্রয়োজন৷ তাদের আদর করে, নিয়ম করে হাঁটতে-দৌড়াতে-খেতে-পড়াশোনা করতে শেখাতে হয়৷ বন্ধুর মতো কাছে বসে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো তুলে ধরতে হয় সামনে৷ আসলে প্রকৃত শিক্ষা বলতে যা বোঝায় সেটা তো শুধু স্কুল-কলেজের লেখাপড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়৷ চারিত্রিক ও আত্মিক উন্নয়নের বিষয়গুলোও যে এ শিক্ষার সঙ্গে জড়িত! আর সেই শিক্ষা বোধ হয় শুরু হয় জন্মের পরপরই৷
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন – সকলকেই প্রায়ই দেখা যায় বাচ্চার সঙ্গে, এমনকি শিশুর বয়স তিন-চার-পাঁচ-ছায়-সাত বছর পর্যন্তও, ‘ওলে বাবালে', ‘আমার সোনটা মনা' – এ সব আদুরে অর্থহীন ভাষায় কথা বলতে৷ এভাবে কথা বলা মানেই কি ভালোবাসা প্রকাশ? না, কক্ষনো না৷ আমার তো মনে হয়, এতে শিশুরা ঠিকমতো কথা বলতে শেখে না, শেখে না নিজের মনের কথা প্রকাশ করতে৷
আবার দু-তিন বছরের বহু শিশুকেই দেখা যায় খেলনা, জিনিসপত্র নষ্ট করতে, যা খাচ্ছে তার অর্ধেক ফেলে দিতে, খাওয়ার বা অন্য কোনো কাজের সময় অহেতুক লাফালাফি করতে৷ আচ্ছা, এর জন্যও আমরা, মানে অভিভাবকরাই কি দায়ী নই? আমরা কি বলি না – ‘ও তো বাচ্চা, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে' অথবা ‘আমার ছেলে/মেয়েটি ভীষণ দুরন্ত, কী করি বলুন তো?' আর তারপর বাচ্চা আরো একটু বড় হয়ে যখন ঐ একই কাজ করে, আমরা কি তখন তার পিঠে এক ঘা অথবা কান ম'লে দেই না?
নিজেকে একবার জিজ্ঞাসা করুন তো...৷ আপনি কি আপনার সন্তানকে নিয়ম করে একটি জায়গায় বসিয়ে খাইয়েছেন? হাতে মোবাইল ফোন, আইপ্যাড অথবা টেলিভিশন ছেড়ে নয়, বসিয়ে প্রতিদিন গল্পের বই পড়ে শুনিয়েছেন? আপনি নিজে কি সময়মতো খান? বই পড়েন? বা সব জিনিস গুছিয়ে রাখেন? ভুলেও আপনি কখনও তাদের সামনেই ঝগড়াঝাটি করেন না তো? দেন না তো গালাগাল?
বাচ্চারা কিন্তু ছ'মাস বয়স থেকেই শিখতে শুরু করে৷ তখন থেকেই তারা যেমন আদর বোঝে, বোঝে ধমকও৷ বয়স দুই পেরোতে না পেরোতেই বাচ্চাদের নিয়ম-শৃঙ্খলা, সৌন্দর্যবোধ, গুছিয়ে রাখা, নষ্ট না করা, কোনটা করা উচিত এবং উচিত নয় – সেসব বোঝার ক্ষমতা আসে৷ এরপর ছয় বছরের মধ্যে তাদের মস্কিষ্ক পূর্ণতা পায়৷ এই বয়সের মধ্যে সে যা কিছু দেখে, শোনে এবং বোঝে, পরবর্তী জীবনে তার প্রতিফলন ঘটে৷ স্বার্থপরতা অথবা উদারতা, মায়া-মমতা – এগুলো কিন্তু সে আমাদের দেখেই শেখে, অথবা শেখে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছ থেকে৷
ধরুন, আপনার বাচ্চাটা প্রতিদিন টিফিন ফেরত আনে৷ আপনি তখন তাকে যদি বলেন, ‘তুমি টিফিন খাও না কেন? তোমার বন্ধুরা খায় কেন? তুমি বোকা, না গাধা? আজ থেকে তোমার টিফিন বন্ধুরা যেন না খায়৷' এমনটা বলে তাকে কি আপনি আত্মকেন্দ্রিকতাই শেখালেন না? কেন বললেন না মিলেমিশে খাওয়ার কথা? আবার আপনার বাচ্চাটি খারাপ রেজাল্ট করার পর তাকে আপনি হয়ত বললেন, ‘তোমার খালাতো ভাই কত বুদ্ধিমান! খেলাধুলাতেও ভালো৷' অথবা ‘রানা কত ভালো রেজাল্ট করেছে দেখেছো? তুমি তো কিছুই পারো না৷' আচ্ছা, এতে করে আপনি আপনার সন্তানটিকে উৎসাহিত না নিরুৎসাহিত করলেন?
এখানেই শেষ না৷ ঘরে যদি ছেলে থাকে, মেয়েও থাকে, তাহলে অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় বাবা-মা ছেলেটিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে৷ তার পাতে বড় মাছটা, দুধের গ্লাসটা তুলে দিচ্ছি৷ ছেলেটিকে খেলতে পাঠাচ্ছি আনায়াসে, অথচ মেয়েটিকে, সে যদি ছেলেটির চেয়ে বয়সে ছোটও হয়, তাকে বলছি ঘরের কাজে হাত লাগাতে৷ কেন? এটা কি বৈষম্য নয়? এতে করে আপনার ছেলেটি কি কোনোদিন মেয়েদের সম্মান দিতে শিখবে? বড় হয়ে ওরাই কি মেয়েদের উত্যক্ত করবে না, বলুন?
অথচ আমি, আপনারা, আমরা যদি ছোট থেকে ছেলে-মেয়েকে এক চোখে দেখতাম, যদি সান্নিধ্য, সাহচর্য দিয়ে, তাদের সাথে প্রাণখুলে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতাম, গল্প করতাম, বয়ঃসন্ধিতে বন্ধু হতাম – তাহলে হয়ত তাদের প্রতি আমাদের কঠোর হতে হতো না৷ প্রয়োজন হতো না গায়ে হাত তোলার, বকাঝকা করার৷ আর আমাদের কারো কারো সন্তানও হয়ে উঠতো না নিষ্ঠুর, সহিংস এবং পিতৃতন্ত্রের প্রতিভূ৷
আপনারা কি দেবারতি গুহর সঙ্গে একমত? না হলে, জানান আপনার নিজস্ব মতটি৷ লিখুন নীচের ঘরে৷