বদলে যাওয়া শাহবাগ আন্দোলন
২ ডিসেম্বর ২০১৫শাহবাগ আন্দোলনের উপর প্রথম আঘাতটা আসে মতিঝিলে৷ সেদিন মতিঝিল এলাকায় ঝটিকা মিছিল বের করে শিবির৷ অগ্রণী ব্যাংকের লিফট ম্যান জাফর মুন্সী দাঁড়িয়ে ছিলেন ব্যাংকের সামনে৷ আগের দিন ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই পথে নেমেছিলেন আন্দোলনের সমর্থনে৷ তারই ব্যানার ঝুলছে ব্যাংকের সামনের রেলিং-এ৷ মিছিল থেকে এগিয়ে এসে ছিঁড়ে ফেলা শুরু করা হয় সেই ব্যানার৷ জাফর মুন্সী কয়েকজন সহকর্মী সহ এগিয়ে যান, বাঁধা দেবার চেষ্টা করেন৷ কৌশলে তাঁকে একা করে ফেলে জামায়াত-শিবির৷ পাশেই ছিল নির্মানাধীন কোনো এক ভবনের কাজে ব্যবহৃত লোহার ‘এঙ্গেল'৷ সেই এঙ্গেল দিয়ে প্রথমে বাড়ি মেরে ও পরে মাথায় খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়৷ ২০১৩ সালের ভালোবাসা দিবসে দেশের প্রতি ভালোবাসার চূড়ান্ত প্রকাশ করে যান জাফর মুন্সী৷ পরে শিবির এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জাফর মুন্সীর হত্যার দায় চাপায় পুলিশের ওপর৷
ঠিক পরদিন কুপিয়ে হত্যা করা হয় আমার দীর্ঘ দিনের সহব্লগার ও বন্ধু ‘থাবাবাবা', যিনি আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন নামে পরিচিত৷ খুন হবার সময়ে তাঁর ব্যাগে ছিলো ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক লেখা সেই হলুদ ফিতেটি, যা ছিল শাহবাগ আন্দোলনের ব্লগারদের এক পরিচয়পত্র স্বরূপ৷ এটি ছিল শাহবাগ আন্দোলনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত কোনো কর্মীর ওপর প্রথম আঘাত৷ আক্রোশে ফেটে পড়ে মানুষ, শাহবাগ৷ কিন্তু এক অন্যরকম প্রচার চলে সেদিন সারারাত জুড়ে অনলাইনে ও পরদিন মসজিদে৷ রাজীব ভাইয়ের লেখাগুলি অনলাইনে ছড়িয়ে এই আন্দোলন নাস্তিকদের আন্দোলন বলে দাগ কেটে দেবার চেষ্টা করে বিএনপি-জামায়াত৷ পরদিনের আমার দেশ নামক প্রচারিত সংবাদ পত্রটিতে প্রকাশিত রাজীব হায়দারের লেখার অংশটুকু ‘ফটোকপি' করে দেশের সকল অঞ্চলের মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে দেয় জামায়াত-শিবির ও বিএনপির কর্মীরা৷ এই আঘাতটিই ছিল সবচেয়ে বড় আঘাত, সে আঘাত থেকে আজও উঠে দাঁড়াতে পারেনি শাহবাগ৷
অনেকেই বলার চেষ্টা করেন, শাহবাগ আন্দোলনের জন্যই ব্লগাররা মারা যাচ্ছেন, দেশ সংকটে৷ তাঁরা আসলে ভুলে যান ঠিক শাহবাগ আন্দোলন শুরুর আগের মাসে আসিফ মহিউদ্দীনের উপর আক্রমণ হয়েছিল হত্যা করবার উদ্দেশ্যে৷ ব্লগারদের উপর যে আক্রমণ সে আক্রমণকে বলা যায় ‘টার্গেটেড ইন্টেলেকচুয়াল কিলিং', যেটা একাত্তরে আল-বদরেরা করেছিল৷ আর সকল মুক্তমনা ব্লগারই প্রগতিশীল আন্দোলনের সমর্থক হিসেবে শাহবাগ আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক, কেউ কেউ সরাসরি কর্মীও ছিলেন৷ তাই ব্লগার হত্যা মানেই শাহবাগ আন্দোলনের কর্মী হত্যা এটা বড়দাগে বলা গেলেও, হত্যাকারীদের কাছে হয়তো এটি ‘মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ'৷
রাজীব হত্যাকাণ্ডের পর কিছু হত্যাকাণ্ড পর পর ঘটে যায়৷ সিলেটের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জগতজ্যোতি তালুকদার, শাহবাগের উপর নজর রাখার জন্য নিয়োজিত সিসি ক্যামেরার দ্বায়িত্বরত পুলিশ কন্সটেবল বাদল মিয়া, সাতক্ষীরার ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মামুন, বুয়েটের হোস্টেলে আরিফ রায়হান দ্বীপ, বগুড়ায় জিয়াউদ্দীন জাকারিয়া৷ এর প্রায় সবগুলির সাথেই সরাসরি জামায়াত-শিবির-হেফাজত এর সংযোগ সরাসরি রয়েছে৷ এই হত্যাকাণ্ডগুলির মূল উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলনকারীদের মনের ভেতর ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেয়া৷ এমনকি চাঁদে সাঈদীকে দেখা গেছে এরকম গুজব দেশব্যাপী ছড়িয়ে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়৷
বিএনপি থেকে প্রথমে এই আন্দোলনকে স্বাগত জানালেও বিদেশ থেকে ফিরে খালেদা জিয়া এই আন্দোলনকারীদের নষ্ট ছেলে বলে অভিহিত করেন৷ এরপর চলতে থাকে একাধারে মিথ্যাচার ও রাজনৈতিক কায়দায় কুৎসিত আক্রমণের পালা৷
সরাসরি সমর্থন দিলেও সরকার সবসময় চেয়েছে এই আন্দোলনকে মুঠোবন্দী করে রাখার৷ শাহবাগের বাইরে গিয়ে কোনো সমাবেশ যেন বড় কোনো শহরে না হতে পারে, সেজন্য বড় সমাবেশের সিদ্ধান্ত নেবার সাথে সাথে তাতে আপত্তি জানানো হয়েছে৷ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ আরো অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে না পারে, এই কারণে চট্টগ্রাম যেতে বাঁধা দেয়া হয়েছে৷ ফেনী থেকে বলা যায় এক প্রকার ফিরে আসতে বাধ্য করা হয়েছে পুলিশ ও র্যাব-এর গাড়ি দিয়ে ঘিরে রেখে৷ এর মাঝে জামায়াত নিষিদ্ধের ‘আল্টিমেটাম' শেষ হয়ে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও এর কর্মসূচী নিয়ে বাকবিতণ্ডায় শাহবাগ আন্দোলনের মিটিং থেকে বের হয়ে যায় ছাত্রলীগ৷ আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে এটাকে ছোট করবার কৌশল হাতে নেয়া হয়৷
এদিকে এই আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে না পেরে বিএনপি শরণাপন্ন হয় হেফাজত নামক ভাড়াটে বাহিনীর৷ হেফাজতের আসলে কোনো সরাসরি রাজনৈতিক আদর্শ নেই, তারা নেতাদের পকেট ভারীর উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেয় কোন দিকে হেলবে৷ বিএনপি জামায়াতের টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গিয়ে হেফাজত ধ্বংশযজ্ঞ চালায় ঢাকা শহরে, যার ফলশ্রুতিতে সরকার বাধ্য হয় তাদেরকে পিটিয়ে মাঠছাড়া করতে৷ কিন্তু রাজনৈতিক কোনো আদর্শবিহীন এই সংগঠনটিকে সরকার সমীহ করে চলতেও বাধ্য, কারণ টাকা দিয়ে এদের কিনে ফেলা যায়, তাই ৩২ কোটি টাকার জমি ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় ২০০ কোটি টাকার বরাদ্দ দিয়ে ‘ভাড়াটে টুপিবাহিনী'-কে হাত করে সরকার৷ সরকারের মাথ্যাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ানো শাহবাগ আন্দোলনকে একই রাতে থামিয়ে দেয়া হয়, কারণ নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য তখন আন্দোলনের সাথে ছাত্রলীগ নেই৷
শত বিরোধীতার মধ্যেও পাকিস্তান হাইকমিশন ঘেরাওয়ের দিন পুলিশ হঠাতই ঝাপিয়ে পড়ে আন্দোলনের কর্মীদের উপর৷ এতদিন যারা পাহারা দিয়ে রাখতো, তাদের মার খেয়ে হতভম্ব হয়ে যায় কর্মীরা৷ তারপর তো পুলিশি আক্রমণ এক নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়৷
এর মাঝে আন্দোলনেরকর্মীদের স্বপ্ন দেখানো হয় বিকল্প রাজনৈতিক দলের৷ গ্রুমিং শুরু করা হয় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়ে৷ কিছু কিছু স্থানের সাথে যোগাযোগ শুরু হয় যাদের সাথে আন্দোলনের আদর্শের রয়েছে সরাসরি বিরোধ৷ এতে অনেকেই সরে যায় আন্দোলন থেকে৷ বিকল্প মঞ্চ তৈরি হয়, মারামারি হয়৷ পাল্টাপাল্টি মামলা দেয়া ও চেয়ার ছোড়াছুড়ির মতো ঘটনা ঘটে৷ এই আদর্শচ্যুতি ও নোংরা ঘটনার ফলশ্রুতিতে আন্দোলন থেকে সরে আসেন অনেকে৷ যে আমি ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে ‘ইভেন্ট' খুলে আন্দোলনের সূচনা করেছিলাম, সরে আসি সেই সন্তানকে ত্যাগ করে৷
এই আন্দোলন ছিল বহুদিন বাদে বাঙালি জাতীয়তাবাদের এক চেতনার উন্মেষ, এক বিস্ফোরণ৷ সেখান থেকে এই পশ্চাদপসরণের কারণ যেমন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির বিরোধীতা, তেমনি স্বপক্ষ শক্তির সন্দেহ প্রবণতা ও ব্যাক্তি বিশেষের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ৷ মানুষ পঁচে যায়, আন্দোলন স্তিমিত হয়, মানুষের মৃত্যু হয়, কিন্তু আদর্শের মৃত্যু হয় না৷ যে চেতনাকে ধারণ করেছে শাহবাগ, সে চেতনা আজো প্রদীপ্ত কোটি বাঙালির হৃদয়ে৷ ধ্বিকি ধ্বিকি জ্বলছে মননে৷ দেশের প্রয়োজনে আবার স্রোত এসে মিলবে মোহনায়৷ গানের মতো স্লোগানে মিলবে কোটি কণ্ঠ ‘জয় বাংলা!'
শাহবাগ আন্দোলন সম্পর্কে আপনার মতামত কী? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷