শিক্ষার্থীদের ‘ঘরে' ও ‘মনের ঘরে' করোনার প্রভাব
২১ মে ২০২১গত একবছরে বাংলাদেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মনস্তত্বের ওপর করোনার প্রভাব নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। অনলাইনভিত্তিক সেসব গবেষণায় সীমাবদ্ধতা থাকলেও, প্রায় সকল জরিপেই উঠে এসেছে এদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা বিষণ্নতা, উদ্বেগ আর মানসিক চাপে ভুগছে। প্রায় এক তৃতীয়াংশ অংশগ্রহণকারী এরকম মানসিক অসুবিধায় ভুগছে বলে উল্লেখ করেছে। এছাড়াও আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যা-প্রবণতার মতো জটিল মানসিক ব্যাধিও লক্ষ করা গেছে।
দেশব্যাপী ৩৯৯৭ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে চালানো এক গবেষণায় উঠে এসেছে শতকরা ৫২.৮৭ ভাগের মধ্যে বিষণ্ণতার উপসর্গ এবং শতকরা ৪০.৯১ ভাগের মধ্যে দূর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক বৈকল্যের উপসর্গ ছিল (সুলতানা, ২০২১)। আঠার থেকে ২৮ বছর বয়সি ৩৩৩১ শিক্ষার্থীর মধ্যে চালানো আরেক জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ১২.৮ ভাগের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে (তাসনিম, ২০২০)।
বিষণ্নতা, উদ্বেগ আর মানসিক চাপ ছাড়াও স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অতিরাগ, জেদ এবং একাকীত্ববোধে ভোগার মতো মানসিক অসুবিধা দেখা যাচ্ছে। বন্ধ স্কুল আর লকডাউনের মতো কর্মসূচির ফলে তাদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াও ব্যপকভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। শিশুর সুস্থ মানসিক ও শারীরিক বিকাশে পরিবার এবং স্কুল উভয়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকে। যেহেতু স্কুল বন্ধ রয়েছে, তাই পরিবারের কাঁধে পুরো দায়িত্ব এসে পড়েছে।
শিশুর বিকাশের জন্য কোনো পরিবারই আদর্শ নয়। প্রায় সকল পরিবারে কোনো না কোনো সীমাবদ্ধতা, যেমন, কলহ, অর্থনৈতিক টানাপড়েন, অপর্যাপ্ত আবাসস্থল, বিদ্যমান থাকে, তার উপর পূর্ণ মাত্রায় শিশুর পড়ালেখার দায়িত্ব পরিবারের ঘাড়ে পড়ায় অনেক বাবা-মাকেও অতিরিক্ত মানসিক চাপে পড়তে হচ্ছে। এই অতিরিক্ত মানসিক চাপ পরিবারের সদস্যদের কথাবার্তা এবং আচরণে প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে শিশুর মধ্যে অতিমাত্রায় রাগ, জেদ এবং হিংসাত্মক আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিশুদের মতে, বাসায় থাকতে আর ভালো লাগছে না, বোরিং লাগছে। দীর্ঘদিন ঘরবন্দি অবস্থা শিশুদের মানসিক বিকাশে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনোবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন।
অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মানসিক অসুবিধার অন্যতম কারণ হিসেবে গবেষণাগুলো চিহ্নিত করছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় তাদের মধ্যে ক্যারিয়ার নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা আর হতাশা দেখা দিয়েছে। এই বয়সে একজন ব্যক্তি ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হয়, সঙ্গী নির্বাচনের জন্য উদ্যোগী হয়। জীবনের এই ধাপকে বলা হয় নিজেকে আবিষ্কার করা এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় (Self-defining period)। এই সময়ের অভিজ্ঞতা অনেকাংশে নির্ধারণ করে একজন মানুষের পরবর্তী জীবন কেমন হবে। অথচ, অতি গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে দেখা যাচ্ছে পরিকল্পনামাফিক কোনো কিছুই হচ্ছে না। যেন সবকিছু থমকে গেছে।
তাছাড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্কও অনেক শিক্ষার্থীকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। পরিবার বা নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কেউ করোনায় সংক্রমিত হলে বা মৃত্যুবরণ করলে তা তরুণ-তরুণীদের মানসিক ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটায়।
অন্যদিকে, কিশোর-কিশোরী কিংবা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা সমবয়সিদের সাথে মিশতে এবং সময় কাটাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সেই সুযোগ নেই। ফলে অনেকেই একাকীত্ব অনুভব করছে বলে মনোবিজ্ঞানীদের কাছে বলছে। এই একাকীত্ব ঘোচাতে তারা ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগের দিকেই ঝুঁকে পড়ছে, যেটা আবার তাদের মধ্যে ইন্টারনেট আসক্তি বাড়িয়ে তুলছে। ইন্টারনেট আসক্তির সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। এই সময় অনেকেই অনিয়মিত এবং অপর্যাপ্ত ঘুম হচ্ছে বলেও অভিযোগ করছে।
সাঙ্ঘাতিক মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা বিশালসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর প্রতি মনোযোগ খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। অথচ অর্থনীতির চাকা চালু রাখা যেমন প্রয়োজন, তার থেকে বেশি প্রয়োজন তরুণ-তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা। রাষ্ট্রীয়ভাবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যেমন কাউন্সেলিং/সাইকোথেরাপির ব্যবস্থা করা এবং তা ছাত্র-ছাত্রীদের নাগালের মধ্যে রাখা খুবই জরুরি।
প্রতিষ্ঠানের সাথে শিক্ষার্থী এবং পরিবারের নিবিড় যোগাযোগ থাকলে ছাত্র-ছাত্রী এবং পিতা-মাতা উভয়েরই মানসিক দুশ্চিন্তা কমিয়ে আনা যায়। বহির্বিশ্বে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করোনার এই সময়ে প্রায় প্রতি সপ্তাহে সরাসরি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ইমেইল করে হালনাগাদ তথ্য জানাচ্ছে, কোন পরিস্থিতে কী করতে হবে, কোথায় যেতে হবে তা বলছে এবং চলমান সংকট মোকাবিলার জন্য কী কী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, তা-ও বিস্তারিত লিখছে। ক্ষেত্রবিশেষে অভিভাবককেও অবহিত করা হচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশের অধিকাংশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে ছাত্র-ছাত্রীদের সরাসরি কোনো যোগাযোগ হয় না। এতে ছাত্র-ছাত্রীরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকে। নানারকম অসত্য তথ্যও ছড়িয়ে পড়ে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য-ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে মাঝে মাঝে ছাত্র-ছাত্রীদের বিরক্তি প্রকাশ পেতে দেখা যায়। শিক্ষক এবং প্রশাসনকে এই সময়ে উদ্যমী, আন্তরিক এবং অধিকতর যত্নবান হতে হবে।
চলমান সংকট সবার জন্য প্রযোজ্য হলেও কমবয়সিদের মানসিক অবস্থা মাথায় রেখে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ, বিশেষ করে বাবা-মাকে এই সময়ে সন্তানের সাথে পারস্পারিক সম্পর্ক উন্নয়নের প্রতি জোর দিতে হবে। সন্তানের আচরণকে সবসময় যুক্তি এবং সামাজিক নিয়মের বেড়াজালে ফেলে বিচার না করে সহানুভূতির সাথে দেখতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশ, পারিবারিক কাজ বা কায়িক পরিশ্রমে অংশ নিলে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর করোনার ক্ষতিকর প্রভাব অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব।